আগামীর জন্য যে শিক্ষা রেখে গেলেন শেখ হাসিনা
গত জুলাই মাসের শুরু থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত সময়টা ছিল এ দেশের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। কেউ ভেবেই উঠতে পারেনি যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ইস্যুকে কেন্দ্র করে তা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আন্দোলন শুরুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাটা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এই আন্দোলনের আগুন যখন বাড়তে শুরু করে, তখন তার সঙ্গে শুধু ছাত্ররা নয় বরং একে একে শিক্ষক, অভিভাবক থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও নিজেদের মতো করে এই আগুনে বাতাস দিতে থাকে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৮ জুলাই সংঘর্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট বন্ধ রেখে দেশের তথ্য-যোগাযোগকে ব্যাহত করা। এর পরের ঘটনা আমাদের সবারই জানা। তবে ৫ আগস্ট যা ঘটল, তা বাংলাদেশের জন্য তথা আওয়ামী লীগের জন্য একটি জঘন্য ঘটনা। আওয়ামী লীগের যত অর্জন ছিল, তা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ থেকে চলে গেলেন শেখ হাসিনা।
যা হোক, বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনা তাঁর এ ক্রান্তিকালে তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের সহযোগিতা পাননি।
এটা শতভাগ সত্য, কারণ গণমাধ্যমের খবরই বলে দিচ্ছে গত এক সপ্তাহে তাঁর দলের বহু হেভিওয়েট নেতা-কর্মী দেশত্যাগ করেছেন। আওয়ামী লীগ–সমর্থিত যেসব বাঘা বাঘা ব্যবসায়ী ছিলেন, যাঁরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে চলছিলেন, তাঁরাও তাঁকে সহযোগিতা করেননি। এর পেছনের কারণ হচ্ছে, শেখ হাসিনা তাঁর অধীন সব খাতে নিজের অনুসারী লোকবল নিয়োগ করে রেখেছিলেন, যা সম্পূর্ণরূপে একনায়কের বহিঃপ্রকাশ। এতে এমন একটি চেইন অব কমান্ড তৈরি হয়, যা আসলে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছিল। ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে নাম লেখানোর প্রধান উদ্দেশ্য হলো নিজের ব্যবসাকে চাঙা করা; কিন্তু এখানে উল্টোটা হচ্ছিল। কিন্তু কেউই এই চেইন অব কমান্ডের বাইরে যেতে পারছিলেন না। উপরন্তু চলমান ডলার সংকট ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতিও একটি বড় কারণ হয়ে উঠেছিল। শেখ হাসিনা দলের লোকদের সমর্থন না পাওয়ার প্রধান কারণ হলো তিনি গত নির্বাচনে বহু তৃণমূল নেতাকে তাঁদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন।
রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনা অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু তাঁর পেছনে রয়েছে কোটি কোটি ডলারের ঋণের বোঝা, যা প্রকৃতপক্ষে দেশেকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রেখেছে। মেধার সঠিক মূল্যায়ন না করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিপর্যয়, নিজ দলের নেতা-কর্মী, মন্ত্রী ও আমলাদের দুর্নীতি ও কালো টাকার মালিক বনে যাওয়া, দুর্নীতি, ঘুষ ও নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ছাত্ররাজনীতি ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি যেমন আওয়ামী লীগের সমর্থক না হলে নানাভাবে হয়রানি করাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু কেউই এর প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। দেশবাসী প্রত্যাশা করে, এই অন্তবর্তীকালীন সরকার যেন দেশকে তার ক্রান্তিলগ্ন থেকে বের করে এনে একটি দুর্নীতিমুক্ত, সুখী ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র উপহার দিতে পারে। এ মুহূর্তে দেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখা, অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও কৌশলগত দিকগুলো সাবধানতার সঙ্গে মোকাবিলা করা, দেশের নাগরিকদের স্বাভাবিক রেখে পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যেসব কারণে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের অধঃপতন ঘটেছে সেই কারণগুলো যেন আসছে সরকার মনে রেখে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করে।
লেখক: সাজ্জাদ হোসেন রিজু, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক, ঢাকা
* নাগরিক সংবাদে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন দেশের পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]