এক দিনের প্রেম

অলংকরণ: আরাফাত করিম

রাত পোহালে ভর্তি পরীক্ষা। পড়া হয়নি কিছুই। ভাবছি এত দিন কী করলাম, কীভাবে সময়গুলো পার করলাম। এ নিয়ে আফসোস করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ল, আমি নাটোর থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ে আপন গন্তব্যে আসার পথে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ‘বাসায় গিয়ে এখন থেকে সপ্তাহ দুয়েক পড়াশোনা করব না! পরীক্ষার দিন দশেক আগে আবার টুকটাক পড়াশোনা করব।’

কিন্তু তাও হলো না। পরীক্ষার আগের দিন রাতে বই নিয়ে পূর্বে পড়াগুলো শুধু চোখ বুলিয়ে দেখতে থাকলাম, এর মাঝেই পরিকল্পনা করলাম, যেহেতু পরীক্ষার কেন্দ্র ঢাকার বকশীবাজারের বদরুন্নেসা গার্লস কলেজে পড়েছে সেহেতু পরীক্ষার পর পায়ে হেঁটে চানখাঁরপুল, নাজিমুদ্দীন রোড, চকবাজার, বেগমবাজার, আরমানিটোলা, ইসলামপুর, বাংলা বাজার, সদরঘাট হয়ে নবাবপুর রোড ধরে গুলিস্তান ঘোরাঘুরি করে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চড়ে বিমানবন্দর হয়ে বাসায় চলে যাব, আম্মুকেও তাই বলছি। তাছাড়া বন্ধুর সঙ্গে কেন্দ্রে যাওয়ার কথা থাকলেও, কেন্দ্র একসঙ্গে না পড়ায় বন্ধু কীভাবে যাবে সেই পথ নির্দেশনা দিয়ে বিদায় নিলাম।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ঘড়ির এলার্মে সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হয়ে একা বেড়িয়ে পড়লাম পরীক্ষার উদ্দেশ্যে। নিউমার্কেটগামী বাস না পেয়ে শাহবাগের বাসে চড়ে বসলাম। একই স্টপেজ থেকে বাসে উঠে পাশে বসল অপরিচিত একটি মেয়ে। জানতে পারলাম সেও পরীক্ষার্থী, কেন্দ্র ইডেন মহিলা কলেজ। মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞাসা করল, শাহবাগ থেকে নিউমার্কেট কীভাবে যাওয়া যায়?
শাহবাগ থেকে পায়ে হেঁটে বা রিকশায় যেতে পারবেন, আমি বললাম।
আপনিও কি সেদিকে যাবেন?
হ্যাঁ, আমিও নিউমার্কেট হয়ে ইডেন কলেজের সামনে দিয়ে যাব।
আমি কি আপনার সাথে যেতে পারি? মেয়েটি বললো
শিউর, বলে আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম। কারণ, কখনো কোনো মেয়েকে সঙ্গে রাখিনি।
বাস শাহবাগ চলে এলো। নেমে পড়লাম একে একে। বারডেম হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমি তাকে বললাম, শাহবাগ থেকে নিউমার্কেট দুভাবে যাওয়া যায়। প্রথমত হচ্ছে ডান দিয়ে কাটাবন হয়ে সায়েন্সল্যাব থেকে সিটি কলেজের সামনে দিয়ে। দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে। পরক্ষণে প্রশ্ন এল, আপনার নাম কী?
তন্ময়, আমি বললাম। ভাবলাম আমি এখন নাম জিজ্ঞাসা করব না, বিদায়ের সময় জেনে নেব।
আপনার কলেজ কোনটা?
ভিজিসি, মিরপুরে, বললাম। আপনার কলেজ? জানতে চাইলাম।
মেয়েটি বলল, কিন্তু বুঝতে পারিনি। অতঃপর বুঝতে পারলাম সে নেত্রকোণা থেকে এসেছে। ঢাকার আশুলিয়ায় তার বোন থাকে, সেখানে উঠেছে।
আচ্ছা, ঢাকায় কখনো আসা হয়েছে, জানতে চাইলাম।
হুম, এদিকে না, সে বললো।

আপনি কি হাঁটতে পারবেন, ১৫–২০ মিনিট লাগবে কিন্তু! না রিকশা নেব?
— না, আমি হাঁটতে পারি, মেয়েটি বলল।
আপনি যেহেতু এখানে নতুন সেহেতু আশেপাশের জায়গাগুলো সম্পর্কে পরিচিত করিয়ে দেয়, তাকে বললাম।
এটা হচ্ছে শাহবাগ মোড়, ওটা জাতীয় জাদুঘর। এই পুরোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং এটা কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি। আর এটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।
মেয়েটি কথা একটু কম বলা শুরু করল।
এটা টিএসসি আর এই পথ ধরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, কার্জন হল, ঢাকা মেডিকেল।
মেয়েটি বলল এসব জায়গা তার ভালো লাগে না। এও বলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার পছন্দ না। মনে মনে ভাবলাম, মেয়েটি হয়তো ভয় পাচ্ছে! ভয় লাগারও কথা, স্বাভাবিক।
আচ্ছা এটা রোকেয়া হল।
মেয়েদের না? সে বললো।
হ্যাঁ। এদিকে কলা ভবন আর এটা ভিসি চত্বর। এটাই ভিসির বাসভবন। আমি বলছি আর সে শুনে এবং দেখেই যাচ্ছে।

এ জায়গাটা নীলক্ষেত আর সামনেই নিউমার্কেট। ডান পাশে সব বইয়ের বাজার। মেয়েটি পরীক্ষার পর কীভাবে ফিরবে এ নিয়ে তাকে বলতে বলতে দুজন চলে আসলাম ইডেন কলেজের সামনে। ভাবলাম নামটা জিজ্ঞেস করবো, না থাক, জিজ্ঞেস করতে যেন ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি। তারপর আর জিজ্ঞেস করিনি। গেটের সামনে তাকে রেখে বিদায় নিলাম। কিন্তু আঁচ করতে পারলাম সে পেছন পেছন আসছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে আমাকে কিছু একটা বলবে, তাই পেছনে আসছিলো কিন্তু আমি বোঝাতে দেইনি। পুরোপুরি বুঝতে পেরে আবার সর্বশেষ বিদায় দিয়ে রোড ক্রস করে ছুটে চলছি বদরুন্নেসায়।
পরীক্ষা শেষ। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবলাম ঈদ মৌসুমে ট্রেনে প্রচুর ভিড় হবে, ওদিকে আর যাওয়ার দরকার নেই। যা প্ল্যান করেছিলাম, সব ভেস্তে গেল! যেভাবে আসছি, সেভাবেই  হাঁটছি আর ভাবছি ভাগ্যে থাকলে এখন আবার ওই মেয়ের সাথে দেখা হবে। নিউমার্কেট এসে মোড় অতিক্রম করবো ঠিক সে সময় পেছন থেকে তন্ময় বলে ডাক দিল।
পেছনে তাকিয়েই দেখলাম সেই মেয়েটি। বাহ!
আপনি এখনো যাননি? ভাবলাম চলে গেছেন!
— না, বাস পাইনি।
আচ্ছা, আসেন! দুজনে যাচ্ছি। ভাবলাম এবার বিদায় দেওয়ার সময় যেভাবেই হোক নাম জিজ্ঞেস করবই! নিউমার্কেট বই বাজারের পাশ দিয়ে হাঁটছি।
আপনি কিছু খাবেন? জিজ্ঞেস করলাম।
— না
কিছু কিনবেন?
— হ্যাঁ, ব্যাগ কিনব, সে বললো।
আচ্ছা, কি ব্যাগ? চলেন যাই!
মার্কেটের পাশে নিয়ে গেলাম। সে ব্যাগ কিনছে, আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি।
ব্যাগ কেনা শেষ। আবার হাঁটতে থাকলাম দুজনে। নীলক্ষেত মোড়—
রিকশা নেবো, না হাঁটতে পারবেন? জিজ্ঞেস করলাম।
— নেওয়া উচিত, সে জানাল।

আচ্ছা, চলেন ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে  রিকশা ঠিক করি।
অতঃপর রিকশা নিলাম। রিকশায় দুজনে বসে পড়াশোনা, পরিবার নিয়ে টুকটাক আলাপচারিতা হচ্ছে। চলে এলাম শাহবাগ। রিকশা থেকে নামতেই বাস পেয়ে গেলাম, উঠে পড়লাম দুজন। বাস ছুটে চলছে, একের পর এক জায়গা অতিক্রম করছে। এদিকে দুজনের ব্যক্তিগত জীবন, লাইফস্টাইল, ঘোরাঘুরি সম্পর্কে বেশ গল্প জমে উঠেছে। ওদিকে বিজয় সরণি সিগন্যালে পড়ে তাকে বোঝালাম কতটা বিরক্তির কারণ এ সিগন্যাল। যাহোক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পুরাতন বিমানবন্দর, ঢাকা সেনানিবাস এলাকা দেখিয়ে বিভিন্ন  বিষয়ে আলাপ চলছে।
আপনি আমার নাম জানেন? মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করল।
— না, নামটা জানা হয়নি। ভাবছিলাম বিদায়ের সময় জিজ্ঞাসা করব। আচ্ছা আপনার নাম কী?
আপনি বললেন না বিদায়ের সময় জিজ্ঞাসা করবেন, তখনি জেনে নিয়েন, মেয়েটি বলল।
ঘোরাঘুরি নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে সে বলে উঠল,
চলেন ঘুরতে যাই।
ঘুরতে যাবেন? কোথায় যাওয়া যায়? জিজ্ঞেস করলাম।
— আমি তো চিনি না। আপনি তো চেনেন, চলেন!
আমি ভাবতে থাকলাম এই তীব্র রোদের দুপুরে কোথায় যাওয়া যায়!
আচ্ছা, চলেন উত্তরার সেক্টর ৭ এর পার্কে যাই।
এটায় গিয়েছি, মেয়েটি বললো।
আচ্ছা, আপনার নাম কী? আবার জিজ্ঞেস করলাম।
— বলব না, যাওয়ার সময় জেনে নিয়েন।
নামটা বলল না। কেন যে সেটা বলতে গেলাম। যাহোক কি করার! মাঝদুপুরে দুজন বাস থেকে নেমে পড়লাম উত্তরার আজমপুরে। তাকে নিয়ে সেক্টর ৭–এর এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করলাম। দুজন চা-আইসক্রিম খেলাম, গল্প করলাম। এদিকে দুপুর থেকে বিকেল গড়ছে। ভাবছি মেয়েটির বোনের বাসা থেকে হয়তো তাকে নিয়ে চিন্তা করছে। করবে না কেন, পরীক্ষা শেষ হয়েছে সে কখন কিন্তু এখনো বাসায় ফেরেনি। তাকে বিদায় দিতে হবে আমার।
হাউজবিল্ডিং বাস স্টপেজে এলাম, বাসে উঠিয়ে দেব। সে ফোন বের করল। নাম্বার, সোশ্যাল মিডিয়া আদান-প্রদান হলো। ইনস্টাগ্রামের বরাতে জানতে পারলাম, মেয়েটির নাম নাফিসা। নাম জেনে চুপ করে থাকলাম। কিছু বললাম না। যাহোক অতঃপর বাস চলে আসায় তাকে গাড়িতে তুলে বিদায় দিলাম। বাসায় ফিরে ভার্চ্যুয়ালি কথোপকথন—
বাসায় গিয়েছেন? জিজ্ঞেস করলাম।

— হ্যাঁ, মাত্র এলাম।
লাইফে ফার্স্ট টাইম আনএক্সপেক্টেড কিছু হয়ে গেলো (আজকে), নাফিসা বললো।
— আমারও আনএক্সপেক্টেড ছিল আজকের ঘটনাটা। কি থেকে কি হয়ে গেলো!
আমি পরিচিত ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে হেল্প নিই না, হেল্প নেওয়া তো দূরে থাকুক, কথা পর্যন্ত বলি না। কিন্তু আজ সকাল থেকেই ভয় পাচ্ছিলাম, আমি পরীক্ষা দিতে পারব না। আমার সঙ্গে পরিচিত কারোরই একই কেন্দ্র পড়ে নাই। এটাতে পুরোটাই একা ছিলাম। তাও বাধ্য হয়েই কথা বলতে হলো। পরে, পুরো সিনেমেটিক কাহিনি হয়ে গেল। অনেকটা ‘বোঝে না সে বোঝে না সিনেমা’র মতো হয়ে গেছে, পার্থক্য শুধু একটাই, ওই ছবিতে একজন ইন্টারভিউ দিচ্ছিল আর অন্যজন চাকরি করছিল। আর এখানে আমরা দুজনই শিক্ষার্থী! আচ্ছা, পরে কথা হবে, ফোনে চার্জ নেই, নাফিসা বললো।
আচ্ছা, ভালো থাকবেন, আমি বললাম।
— ওকে আপনিও।
এভাবেই একটি অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠলাম। শুধু পরিচিত নয়, বরং রীতিমত সকাল থেকে বিকেল অব্দি ঘোরাঘুরি হয়ে গেলো, একটা ডে ট্যুরই বলা যায়। লিখছি, তবুও এখনো মনে করছি, কী থেকে কী হয়ে গেল! সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনা ঘটে গেল! এভাবেই হয়তো জীবনের ঝুলিতে যোগ হয় ভাই-বোন, বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসার মুহূর্তের চলচিত্র। সেই মুহূর্তগুলো একসময় স্মৃতির পাতায় পাখা মেলে পাখির মতো মেঘলা আকাশে উড়তে চায়, আর স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতিবার! নাফিসা ভালো থাকবেন, ভালো রাখবেন। দেখা হবে আবার, ভাগ্যে থাকলে শতবার।

  • লেখা : মো. তন্ময় হাসান সিয়াম, কবি ও ভ্রমণলেখক