অসীমের পথে জ্বলুক জ্যোতি
খ্যাতিমান রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ প্রয়াত হয়েছেন। যত দূর জানা যাচ্ছে, তিনি এই পৃথিবীকে তাঁর জন্য স্রেফ অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন। পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অনন্ত অসীমে চিরস্থায়ী ঠিকানা গড়েছেন। শিল্পী তাঁর নিজের ইচ্ছার কাছে পূর্ণ আত্মনিবেদন করেছেন। বিক্ষিপ্ত স্রোতস্বিনীর মতো নিজের বহমান মনকে প্রশান্তির মোহনায় মিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর নিজের কাছে পূর্ণ স্বাধীন।
এমন এক বাস্তবতায় যাঁরা এই শিল্পীর মৃত্যুকে নানা কটূ কথায় কালিমালিপ্ত করছেন, তাঁরা কি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন, মাত্র কয়েক সেকেন্ড পর আপনি কী করবেন, কোথায় হারাবেন? না, পারবেন না। তারপরও আপনাদের সাদি মহম্মদের মতো জাতশিল্পীর প্রতি ঘৃণা উগ্রে দিতে হবে!
আপনারা কারা হে তিক্ত ও ত্যক্ত নেটিজেন? আজকের এই বাংলাদেশ বিনির্মাণে আপনাদের ভূমিকা আসলে কী? সাদি মহম্মদের পরিবারটিকে চিনে রাখুন।
বিবিসি বাংলা লিখেছে, সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। তাঁর বাবা সলিমউল্লাহ ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ অবাঙালি প্রতিবেশীরা তাঁদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন এবং তাঁর বাবাকে বাড়ির সামনে হত্যা করা হয়।
পরবর্তী সময় তাঁর নামেই মোহাম্মদপুরের সলিমউল্লাহ রোডের নামকরণ করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন সাদি মহম্মদ। তবে তাতে মন বসেনি তাঁর। সে সময়ই শান্তিনিকেতনে পড়ার সুযোগ পান তিনি। বৃত্তি পেয়ে ১৯৭৫ সালে সংগীত বিষয়ে সেখানে পড়তে যান তিনি। এরপর বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।
পরে সংগীতের প্রাজ্ঞ শিক্ষক ও গর্বিত শিল্পীসত্তা নিয়ে আনন্দমুখর জীবন কাটিয়ে গেলেন। আনন্দেরও সখা হয়ে থাকে অগণন দুঃখবোধ। ওই দুঃখ শিল্পী একা বয়েছেন। আপনাদের কারও করুণা ভিক্ষা তিনি কোনো দিন করেননি। আপনারা বা এই রাষ্ট্র তাঁকে কী স্বীকৃতি দিল বা না দিল, তাতে সাদি মহম্মদের কিচ্ছু এসে যায়নি। মনে অভিমান পুষলেও বিচিত্র তৈলের ভাণ্ড নিয়ে কারও দ্বারস্থ তিনি হননি। কাজেই চূড়ান্ত বিচারে এটাই পরমানন্দে তাঁর প্রাণান্ত সমর্পণ হিসেবে বিবেচিত হলো।
৭৬ বছর বয়সে মিশ্র পূরবী রাগে ৩ ডিসেম্বর ১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতনে বসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গান লিখেছিলেন। বলে দিয়েছিলেন, তাঁর জীবদ্দশায় যেন গানটি গীত না হয়। শিল্পী সাদি মহম্মদের এই গানটি খুব প্রিয় ছিল।
সমুখে শান্তিপারাবার-
ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।
তুমি হবে চিরসাথি, লও লও হে ক্রোড়
পাতি-
অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি
ধ্রুবতারকার।।
মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা তোমার দয়া
হবে চিরপাথেয় চিরযাত্রার।
হয় যেন মর্তের বন্ধনক্ষয়, বিরাট বিশ্ব
বাহু মেলি লয়-
পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয় মহা-অজানার।।
সাদি মহম্মদ চিরযাত্রার চিরপাথেয়টি নিশ্চয়ই তাঁর মুক্তিদাতার কাছ থেকে বুঝে নিয়েছেন।
‘শিল্পীরা তো একটু অভিমানী হয়। অনেক কিছু নিয়েই হয়তো তার মধ্যে অভিমান ছিল, হয়তো আমরা ধরতে পারিনি’, প্রয়াত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদকে নিয়ে বিবিসি বাংলাকে কথাগুলো বলছিলেন নৃত্যশিল্পী ও তাঁর পারিবারিক বন্ধু শামীম আরা নিপা। বেশ কিছুদিন ধরে সাদি মহম্মদ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন বলে বিবিসিকে জানান বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই নৃত্যশিল্পী।
‘বিশেষ করে গত বছর জুলাইয়ে তাঁর মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ ও বোনের মৃত্যুর পর তাঁর মধ্যে আত্মহত্যার বিষয়টি প্রবল হয়ে ওঠে এবং কাজের স্বীকৃতি পাননি বলেও অভিমান ছিল সাদি মহম্মদের,’ বলছিলেন শামীম আরা নিপা।
আজ সব অভিমান আকাশের নীলে লীন হয়ে গেল। আপনাদের নিন্দার বিষাক্ত কাঁটাগুলো তাঁর গায়ে গিয়ে বিঁধবে না আর। মনটাকে বসন্তের পলাশ-শিমুলের সৌন্দর্যে রাঙিয়ে দেখুন, শরতের সফেদ কাশফুলে মাতিয়ে দেখুন, সাদি মহম্মদের মর্মে মন ভিজিয়ে দেখুন, তাঁর আপন পথটাকে এতটুকু কালো মনে হবে না।
সাদি মহম্মদের অন্তিম বিদায়ে তাঁর সতীর্থ, বন্ধু ও শিষ্যরা সমস্বরে রাবীন্দ্রিক সুর গাইছিলেন...
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই--
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই॥
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ,
তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ
আপনার পানে চাই॥
হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা—কিছু সব আছে আছে আছে--
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই।
অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার
রাখিবারে যদি পাই ॥
মহান স্রষ্টার অসীমে আমাদের এই প্রাণ সমর্পিত। অন্তর্গত অসীমেই আমাদের সবার উপস্থিতি। জীবনদাতার উপহার দেওয়া আমাদের এই অমৃত প্রাণখানি পূর্ণ অসীমের তরেই যবে বিলীন করে দিই, তখন আর কোনো দুঃখ, কোনো মৃত্যু, কোনো বিচ্ছেদ থাকে না। ভোরের শিশির হয়ে থাকা আমাদের ভূমিপুত্র, আমাদের আপন শিল্পী সাদি মহম্মদ সেই অসীমের পথে জ্যোতি হয়েই জ্বলুক।