দক্ষ, জ্ঞানী এবং মানবীয় গুণাবলিসম্পন্ন পরবর্তী প্রজন্ম গড়ে তোলার উপায়

জনসংখ্যাপ্রতীকী ছবি

সামাজিক ও মানবিক গুণাগুণসম্পন্ন পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করার মাধ্যমে জবাবদিহিমূলক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে আরও সুসংহত করতে সক্ষম হবে, পরিপ্রেক্ষিত ও আমাদের করণীয়।

যুবসমাজ—মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এখনো রাষ্ট্রগঠনের পরবর্তী পরিকল্পনা থেকে অনেক দূরে। তাদের বাংলাদেশের সংবিধান এবং দেশের উন্নয়ন কাঠামোর সম্বন্ধে সীমাবদ্ধ ধারণা থাকার কারণে তাদের পক্ষে উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন বাস্তবিকভাবেই অসম্ভব। এই বিচক্ষণ ও কর্ম–উদ্যোমী জনগোষ্ঠীকে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে গড়ে তুলতে পারলে নিশ্চিতভাবে দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবলেই পারে প্রশিক্ষিত পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করতে, যারা দেশের উন্নয়নকাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করবে। মানবীয় ও নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন এই জনগোষ্ঠী সমাজে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকবে। স্বপ্নদ্রষ্টা এই প্রজন্মের জন্য এমন একটি মাধ্যম তৈরি করতে হবে, যা তাদের রাজনৈতিক মতের ঊর্ধ্বে থেকে সমাজের ক্ষমতায়নে জোরালো ভূমিকা রাখতে সাহায্য করবে। এ ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা Sustainable Development Goals (SDGs)–কে মূল অবলম্বন করে সব কর্মপরিকল্পনা নির্দিষ্ট করতে হবে, যা তাদের বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। ন্যায্য সমাজব্যবস্থা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুসংহত করবে, যা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও সঠিক ভোট প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণই পারে দক্ষ যুবসমাজ গঠন করতে, যারা সমাজের উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে কর্মরত উন্নয়ন সংস্থাগুলো যুবশক্তিকে আরও সংগঠিত করে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করার মাধ্যমে উন্নয়নকে আরও গতিময় করতে পারে।

পেশাজীবী দক্ষতার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মকে সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন গুণাবলিতে গড়ে তোলা এবং সমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা, সংশ্লিষ্ট মূল পেশাজীবী, যেমন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ব্যবসায়ীরাই পারে সমাজের মৌলিক চাহিদাগুলো অনেকাংশ পূরণ করতে। স্বাধীনতা–পরবর্তী বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের পেশাজীবীর সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা সমাজের উন্নতির রূপরেখা বদলাতে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। নৈতিকভাবে সব পেশাজীবী সমাজের কল্যাণে কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বেশির ভাগ পেশাজীবী এখনো চায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে সমাজগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে। এই পেশাজীবীরাই পারে একটা আদর্শ ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ প্রজন্ম তৈরি করতে, যারা পেশাজীবীদের সঙ্গে সমাজের প্রকৃত সেতুবন্ধ তৈরি করবে।

বিস্তৃত উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে, যাতে অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুব উন্নয়নকে সমানভাবে সংশ্লিষ্ট করা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বপ্রান্তে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, দাতা গোষ্ঠী ও চ্যারিটি সংস্থা তাদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে নিয়োজিত আছে, যারা মূলত দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে কাজ করে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে কেন্দ্র করেই উন্নয়নকাজগুলো বিবর্তিত হচ্ছে, যার মধ্যে দারিদ্র্যদূরীকরণ, ক্ষুধা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচারব্যবস্থা, পরিবেশ, জলবায়ু ও নারীর ক্ষমতায়ন বিশেষভাবে প্রাধান্য পাচ্ছে। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে এমনভাবে নিয়োজিত করতে হবে, যাতে তারা কর্মপ্রক্রিয়া, বাধা এবং উত্তরণের পথ সম্বন্ধে ধারণা পেতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানকে কার্যপ্রণালি ও উন্নয়নসূচকের ওপর নির্ভর করে বিভাজন করতে হবে এবং  প্রয়োজনে অবকাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে, যাতে উৎসাহী প্রজন্ম সহজে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে।

দেশের ৬০ লাখ ছাত্রছাত্রী, যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নরত এবং শিগগিরই চাকরির প্রতিযোগিতায় নামবে, তাদের জন্য ওই পরিকল্পনা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এই ত্রয়ী (ছাত্রছাত্রী, পেশাজীবী ও উন্নয়ন সংস্থা) বিভিন্ন উন্নয়নকাজের সঙ্গে সমাজে মুক্তচিন্তা বিস্তারে প্রভাব রাখবে, যা মানুষকে সঠিক গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। ছাত্রসমাজের সরাসরি অংশগ্রহণেই পারে ২০৩০–এর টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে। কর্তব্যপরায়ণতা ও জবাবদিহিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে সামাজিক উন্নয়নকাজগুলোতে তরুণ যোদ্ধাদের প্রশিক্ষিত করতে পারাই হবে বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রাপ্তি। সমাজ পরিবর্তনের এই কর্মে পরবর্তী প্রজন্ম বিভিন্ন বেসরকারি ও উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে পারবে, যা তাদের পরবর্তী কর্মজীবনে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে। তাদের মধ্যে উন্নয়ন এবং গবেষণামূলক চিন্তাধারা তৈরি হবে, যা তারা উন্নয়নকৌশল তৈরিতে প্রয়োগ করতে পারবে। যুবসমাজের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগদক্ষতা বাড়বে, যা সমাজ ও পেশাজীবীদের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরিতে সহায়তা করবে।

দেশের বর্তমান কার্যকর মানবসম্পদের সংখ্যা এবং উন্নয়নের অবকাঠামো বিবেচনায় এখনই শ্রেষ্ঠ সময় বৈষম্যহীন মানবীয় বাংলাদেশ গড়ার।

*লেখক: ড. জিয়া চৌধুরী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও নীতি বিশ্লেষক