কৃতজ্ঞতা
আমার আম্মা আমার চেয়ে মাত্র ১৫-১৬ বছরের বড়। শুনে অবাক হচ্ছেন? মোটেও বাড়িয়ে বলছি না! আসলে, যখন তাঁর এসএসসি পরীক্ষার সময় ছিল, তখনই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। আর বিয়ের পরের বছরই আমার জন্ম। সেই হিসাবে আমাদের বয়সের ব্যবধান খুব বেশি নয় বললেই চলে। নানু বলতেন, আমাকে ঘুমিয়ে রেখে আম্মা বিলে যেতেন শাপলা তুলতে!
তরুণী হওয়ার আগেই মা হয়ে যাওয়া আমার আম্মা ছিলেন অনেকটাই আলাদা। যাদের সমাজে সবাই অবহেলা করত, তাদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। বিশেষ করে ছিন্নমূল বৃদ্ধাদের প্রতি তাঁর গভীর সহানুভূতি ছিল। এ জন্য বাবা তাঁকে মজা করে ‘কাঙালের ডাইরেক্টর’ ডাকতেন। মজার ছলে বললেও কথাটা একেবারে অমূলক ছিল না। কারণ, আম্মা নিয়মিত তাদের খোঁজখবর রাখতেন।
এসব বৃদ্ধা, যাঁদের বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে, জীবিকার জন্য ভিক্ষাবৃত্তিকেই একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু আম্মা কখনো তাঁদের ‘ভিক্ষুক’ বলে ডাকতে চাইতেন না। আমাদেরও বলতে দিতেন না। তুমি যেহেতু এঁদের অন্ন–বস্ত্রের জোগান দিতে পারবে না সেহেতু তাচ্ছিল্যও করতে পারবে না। তিনি আরও বলতেন, তাঁরা ‘গাওয়াল করে’—মানে জীবনের প্রয়োজনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কিছুটা খাদ্য সংগ্রহ করেন। তাঁর মতে, এটা জীবনের জন্য সংগ্রাম, অপমান নয়।
কখনো কখনো, এই নারীরা যা পেতেন, তা অতিরিক্ত হলে আমাদের বাড়িতে রেখে যেতেন। ভারী কিছু বহনের শক্তি তাঁদের ছিল না। কেউ রেখে যেতেন বারান্দায়, কেউ গেটের পাশে, কেউ–বা রান্নাঘরের এক কোণে পোঁটলা বেঁধে রাখতেন। সেসবের নিরাপত্তা নিয়ে আম্মা ছিলেন সদা সতর্ক। পরে এসে তাঁরা এগুলো নিয়ে যেতেন।
আম্মা আশপাশের ১০ গ্রামের এই ছিন্নমূল নারীদের দুঃখকষ্ট যেন নিজের হৃদয়ে অনুভব করতেন। তাঁরা তাঁর কাছে আসতেন, কথা বলতেন, আম্মা মন দিয়ে শুনতেন। সেই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুখগুলো তখন আনন্দে ঝলমল করত। তাঁদের চোখেমুখে প্রশান্তির ছাপ পড়ত।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমার স্বল্পশিক্ষিত আম্মা বুঝতে পারতেন—মানুষ যত ছোটই হোক তার হৃদয় ভালোবাসা চায়, সম্মান চায়। যাদের নেই আশ্রয়, নেই নিশ্চয়তা, তারা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চায় একটু প্রশ্রয়, একটু শ্রদ্ধা, একটু মানুষের মতো আচরণ। আর আমার আম্মা তাদের সেইটুকু দিয়ে দিতেন অকপটে, নিঃস্বার্থভাবে। আমরাও আস্তে আস্তে এসবের সঙ্গে মানিয়ে নিলাম।
তখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি, গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। আমি আর ছোট দুই বোন আধা পাকা আমে কাসুন্দি দিয়ে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে বাড়িতে প্রবেশ করেন এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী, যাঁকে সবাই পেরেবান নামে ডাকতেন! প্রায় ছয় মাস ধরে তিনি এই এলাকায় ঘোরাফেরা করতেন। রেলস্টেশনে থাকতেন আর পথে ঘুরে ঘুরে যা পেতেন—পুরোনো কাপড়, পলিথিন, ছেঁড়া জুতা, সেগুলো শরীরে পেঁচিয়ে রাখতেন। পয়সা, পাথরের টুকরা, পেরেক—এসব মুখে পুরে রাখতেন, ফলে মুখটা ফুলে থাকত।
সব মিলিয়ে পেরেবানকে দেখতে ভয়ংকর লাগত। হাতে সব সময় থাকত লাঠির মতো কিছু একটা। কেউ তাঁকে বিরক্ত করলে দৌড়ে তাড়া করতেন। আমরা সবাই তাঁকে খুব ভয় পেতাম।
সেদিন সেই ভয়ংকর পেরেবান হঠাৎ আমাদের বাড়ির বারান্দায় এসে ধপাস করে বসে পড়েন। আমি আর ছোট বোন ভয়ে চিৎকার শুরু করি! আম্মা তখন গোয়ালঘরে দুধ দোয়াচ্ছিলেন। দৌড়ে এসে দেখেন, পেরেবান বারান্দায় বসে আছেন আর আমরা ভয়ে থরথর করছি।
আম্মা একেবারে ভয় পেলেন না। যেন বাড়িতে অতিথি এসেছেন! তিনি পেরেবানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি ক্ষুধার্ত?’ কোনো উত্তর নেই। তাঁর শরীর থেকে উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে, মাথার ওপর মাছি ঘুরছে। কিন্তু আম্মা কিছুই কেয়ার করেন না। পাশে বসে ফিসফিস করে কিছু একটা বলেন। পেরেবান নির্বিকার। আম্মা নির্বাক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি আমাকে পানি গরম করতে বলেন। ছোট বোনকে বলেন কাঁচি আনতে। ছোট বোন কাঁচি নিয়ে ভয়ে ভয়ে কাছে যায়। তারপর তারা দুজনে মিলে পেরেবানের মুখের ভেতর থেকে সবকিছু বের করে, চুল কেটে দেয়, কাপড়ের প্যাঁচ খুলে গোসলখানায় নিয়ে যায়। আশ্চর্য, পেরেবান একটুও জোর করলেন না, লাফালাফি বা ছোটাছুটি কিছুই করলেন না!
ঘণ্টাখানেক ধরে পেরেবানকে ভালো করে গোসল করিয়ে দেন আম্মা। তারপর শরীরের বিভিন্ন ক্ষত গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করে বরিক পাউডার লাগিয়ে দেন, সালোয়ার–কামিজ পরিয়ে দেন। কামিজের ওপরে আম্মার একটা পুরোনো শাড়ি পেঁচিয়ে গিঁট লাগান, যাতে সহজে খুলে না যায়। সবশেষে দুধ আর আম দিয়ে এক থালা ভাত খেতে দেন। পেরেবান বারান্দায় পিঁড়িতে বসে ভাত খেয়ে আম্মার দিকে ফ্যালফ্যাল করে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। সেই তাকানোর মধ্যে যে কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল, তা প্রকাশের ক্ষমতা আমার নেই।