আর কখনো ফেরা হবে না চিরচেনা সেই গোয়ালে

গ্রাম ছেড়ে অচেনা শহরে, অচেনা এক জগতে। ফেরা হবে না চিরচেনা সেই গোয়ালে প্রিয় মালিকের কাছে! অর্থের কাছে হেরে যায় হাজারো ভালোবাসা। কখনো কি শুনতে চেয়েছিলেন তাদের গল্প? অনেক কিছু বলতে চায় এই চোখ।

জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, প্রিয় গোয়ালে ফেরা হবে না আর। লাফালাফি করে দিন কাটিয়ে দেওয়া যাবে না। প্রিয় মালিকের চোখও সেদিন ভিজেছিল, যেদিন সে আমাকে জোর করে একটি বাহনে উঠিয়ে এখানে নিয়ে আসে।

আমার মালিক শুধু ভেজা চোখ বারবার মুছছিল। পেছন পেছন আমার ছোট ভাইদেরও অনেক আর্তনাদ ছিল। কী আর করার! আর ফেরা হবে না আমার শৈশব কাটানো চিরচেনা সেই গোয়ালে।

একজন মালিকের কাছে পোষা প্রাণীর চেয়ে আপন আর কী হতে পারে। পোষা প্রাণীগুলো হয়ে ওঠে মালিকের কাছে নিজের সন্তানের মতো, যেন পরিবারের নিত্যদিনের একজন সদস্য। আর যখন নিজের সন্তানের মতো ভরণপোষণের মাধ্যমে গড়ে তোলা সেই পোষা প্রাণীদের উৎসর্গ ও ত্যাগ করতে হয় একপ্রকার নিরুপায় হয়ে, তখন মালিকের আর্তচিৎকারে কয়জনই-বা শোনে। এই ত্যাগ ও উৎসর্গ শুধু মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য।

পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি একটি শব্দ হচ্ছে মা-বাবা। মা-বাবার কাছে একটি সন্তান যেমন তাঁদের জগৎ, তেমনি সন্তানের কাছে তার মা-বাবাই সব। আর এ জন্য মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যকার সম্পর্কটি সবচেয়ে মধুর। একটি সন্তান যখন ঠিকমতো খেতে পারে না, কথা বলতে পারে না, এমনকি নিজের কাজ নিজেও করতে পারে না, তখন তাকে আগলে রাখেন মা-বাবা। পরম মমতার চাদরের উষ্ণতায় তাকে বড় করে তোলেন। সন্তানের সব আবদার মা হাসিমুখে মেনে নেন। শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে যে মানুষগুলো একটু আদর আর ভালোবাসায় আমাদের সব বেদনা দূর করে দেন, তাঁরাই হলেন মা-বাবা।

সন্তানের জন্য তুলনামূলকভাবে মা-বাবাই বেশি ত্যাগ স্বীকার করেন। ঠিক মালিক আর পোষা প্রাণীর সম্পর্ক হচ্ছে মা-বাবা ও সন্তানের মতো। সন্তানদের যেমন মা-বাবা আদর-যত্ন করেন, দেখাশোনা করেন, ভরণপোষণ করেন এবং ভালোবাসেন, ঠিক তেমনই একজন প্রকৃত মালিক তাঁর পোষা প্রাণীদেরও সেভাবে লালন–পালন করেন ও ভালোবাসেন।

বাড়ির পোষা প্রাণীটি বেড়ে ওঠে মালিকের চোখের সামনেই। তারাও কিন্তু এ পরিবারের সদস্য। চার দেয়ালে আটকে থাকা পোষা প্রাণীটির সঙ্গে মালিকের অনেক স্মৃতিবিজড়িত মুহূর্ত থাকে। মালিকের সঙ্গে পোষা প্রাণীটির সম্পর্ক থাকে নিবিড় ঘনিষ্ঠ। মালিক পুরো দিনের বেশির ভাগ সময় অতিক্রম করেন পোষা প্রাণীদের সঙ্গে।

প্রাণীগুলোকে সকাল সকাল গোয়াল থেকে বের করে মাঠে নিয়ে যান ঘাস খাওয়ানোর জন্য, মাঠে চরানো শেষ হলে পোষা প্রাণীটিকে গোসল করান, তারপর পছন্দমতো খাবার খেতে দেওয়া হয়। অতঃপর সন্ধ্যায় তার স্থায়ী ঠিকানা চিরচেনা গোয়ালে নিয়ে আসেন। মাঝেমধ্যে মালিক তাঁর পোষা প্রাণীকে শাসন করেন। এভাবে মালিক আর সেই পোষা প্রাণী শৈশব থেকে বড় হয়ে ওঠে তাদের মধ্যকার খুনসুটিতে। পোষা প্রাণী হতে পারে গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি।

কিন্তু সন্তানের মতো সেই পোষা প্রাণীদের একপর্যায়ে ত্যাগ ও উৎসর্গ করতে হয় একপ্রকার নিরুপায় হয়ে। এত বড় ত্যাগ স্বীকার শুধু কোরবানির জন্য। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সুবহে সাদিক থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সুস্থ-সবল গৃহপালিত পশু জবাই করাকে কোরবানি বলে।

এ ত্যাগ ও উৎসর্গ কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিবেদিত হবে। মালিক আর গোয়ালের সঙ্গে পোষা প্রাণীর বিচ্ছেদ ও সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে এই ত্যাগের বিনিময়ে।

  • হেদায়েতুল ইসলাম নাবিদ, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।