রোগীর নিরাপত্তার স্বার্থে রোগীকেই সম্পৃক্ত হতে হবে

আপনার সমস্যা বলুন, কত দিন যাবৎ? এর আগে কাউকে দেখিয়েছেন? কী কী ওষুধ খাচ্ছেন? কেনইবা ভালো হচ্ছেন না! এ কথাগুলো একজন রোগীকে চিকিৎসকের কাছ থেকে সব সময় শুনতে হয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু রোগীর সেফটি অর্থাৎ নিরাপত্তার ব্যাপারটা অনেক সময় অগোচরে রয়ে যায়। ফলে রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রাণনাশের ঝুঁকি থাকে। সময়ের প্রয়োজনে একটি বিষয় ভীষণভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে যে রোগীর নিরাপত্তার স্বার্থে রোগীকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং রোগীর কণ্ঠ আরও সোচ্চার হতে হবে।

১৭ সেপ্টেম্বর ‘ওয়ার্ড পেশেন্ট সেফটি ডে’ বা ‘বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস’ পালিত হয়। বিশ্বের সকল রোগীর সেফটি বা নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের দেশসহ সব দেশ এবং আন্তর্জাতিক বন্ধু ভাবাপন্ন দেশগুলো একক ও সামগ্রিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৯ সালে ৭২তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশে ‘গ্লোবাল অ্যাকশন অন পেশেন্ট সেফটি’ রোগীর সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপ কর্মসূচি গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে ১৭ সেপ্টেম্বরকে ‘ওয়ার্ড পেশেন্ট সেফটি ডে’ বা ‘বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রোগীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে এবং সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্তর্ভূক্ত দেশসমূহ একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সবাইকে সম্পৃক্ত করা, সারা বিশ্ব যেন একই মনোভাব নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

এ বছর ‘বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস’-এর প্রতিপাদ্য হলো ‘এনগেজিং পেশেন্ট ফর পেশেন্ট সেফটি’ অর্থাৎ রোগীর সম্পৃক্ততাই রোগীর নিরাপত্তা। একই সঙ্গে ‘এলিভেটেট দ্য ভয়েজ অব পেশেন্ট ফর পেশেন্ট সেফটি’ মানে রোগীর নিরাপত্তায় রোগীর কণ্ঠ সোচ্চার হোক—এই স্লোগান নিয়ে বিভিন্ন পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার, সেমিনার, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছে সচেতনতামূলক প্রচার অভিযান চলছে। তথ্য বলছে, প্রাথমিক এবং বহির্বিভাগ স্বাস্থ্য সেবায় প্রতি ১০ জনে ৪ জন অর্থাৎ ৪০% রোগী কোনো না কোনোভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এমনকি অনিরাপত্তাজনিত সেবার (অনসেফ কেয়ার) কারণে প্রতি মিনিটে ৫ জন করে মারা যাচ্ছেন।

এবার আসা যাক, রোগীর নিরাপত্তা বলতে কী বোঝায় এবং এ বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবসের মূল উদ্দেশ্য কী? প্রথমেই রোগীর নিরাপত্তা, আসলে একজন মানুষ যখন রোগাক্রান্ত হন, তখন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় রোগী একজন চিকিৎসকের কাছে যান। যথাবিহিত সম্মানিত চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অবস্থা ও ল্যাবসংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগের কারণ নির্ণয় করেন এবং যথারীতি ওষুধ প্রেসক্রিপশন করেন। সেই সঙ্গে নিয়মিত ওষুধ খাবার উপদেশ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে রোগের ধরন ও তীব্রতা অনুসারে চিকিৎসক ছাড়াও নার্স, রোগীর নিকট আত্মীয়, রোগীর রক্ষণাবেক্ষক, হসপিটাল বা ক্লিনিকের ব্যবস্থাপকসহ স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংযুক্ত সবাইকে রোগীর বিষয়ে অবহিত করেন এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু তারপরও আমরা দেখেছি সকলের আন্তরিক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও কোথাও না কোথাও অবহেলার কারণে রোগীর জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে। আর তাইতো পেশেন্ট সেফটি বা রোগীর নিরাপত্তা বলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, ‘প্রতিরোধযোগ্য এমন সম্ভাব্য ক্ষতিসমূহ যাতে রোগীদের না হয় অর্থাৎ অনুপস্থিত থাকে এবং রোগীকে চিকিৎসা স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর ঝুঁকিসমূহ যাতে সর্বনিম্ন স্তরে আনা হয়।’

শুধু অনুন্নত দেশ নয়, উন্নত দেশগুলোও কখনো কখনো স্বাস্থ্যসেবার কোনো স্তরে অবহেলার কারণে রোগীর স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত হয় এবং রোগী ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রোগী যখন স্বাস্থ্যসেবার নিয়োজিত চিকিৎসক, সেবিকা, ফার্মাসিস্ট ছাড়াও আত্মীয় স্বজনের বা পরিবারের সদস্যের সঙ্গে নিজেও যদি নিজের যত্নে অংশীদার হয় তবে রোগীর সেফটি বা নিরাপত্তাসহ রোগীর সন্তুষ্টি, এমনকি আরোগ্য লাভেও উল্লেখযোগ্য ফলাফল পাওয়া যায়। তাইতো এবার বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবসে রোগীর নিরাপত্তার স্বার্থে রোগীকেও এগিয়ে আসতে আহ্বান জানানো হচ্ছে।

রোগী যদি তার রোগ, নির্ধারিত চিকিৎসা, ওষুধ, ওষুধের মাত্রা, ওষুধের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত থাকেন এবং নিজে ও নিজের পরিবারের সদস্য, যাঁরা রোগীর সেবায় নিয়োজিত আছেন, সবাই যদি নিয়ম মেনে চলেন, তবেই সম্ভাব্য চিকিৎসা ত্রুটি বা মেডিকেশন এরর হবার ঝুঁকি কমবে। সেই সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, ইনফেকশনজনিত সার্জারি, সেপসিস, শারীরিক ও মানসিক প্রেসার ইনজুরি, বিভিন্ন জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ ইত্যাদি হবার সম্ভাবনা কমে যাবে। রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা ও সেবনবিধি সঠিকভাবে মানতে হবে। যে মাত্রায় যত দিন খেতে বলা হয়েছে, তত দিনের কোর্স অবশ্যই পূরণ করতে হবে। ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস রোগের ওষুধের সেবনে বিশেষ নজর দিতে হবে; যাতে প্রতিদিনের মাত্রা বাদ পড়ে না যায়। যে কোনো ওষুধ গ্রহণের পর যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পার্শপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তবে অবশ্যই নিয়োজিত স্বাস্থ্যসেবা সদস্য, চিকিৎসক, নার্স, সম্ভব হলে ফার্মেসিতে—যেখান থেকে ওষুধ কিনেছেন সেখানেও অবহিত করতে হবে। রোগীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় রোগীর এ সম্মুখযাত্রা রোগীসহ সব রোগীর নিরাপত্তায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, রোগী যদি তাঁর স্বাস্থ্য রক্ষায় সব সময় সজাগ থাকেন, তবে তা তাঁর নিরাপত্তার স্বার্থে ফলাফল উল্লেখযোগ্য। এটি প্রমাণিত যে রোগী নিজেকে সম্পৃক্ত করার কারণে রোগীর সম্ভাব্য ক্ষতির ১৫% কমেছে, কমেছে চিকিৎসা ত্রুটি, অনেক জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। তাইতো বলা হচ্ছে, রোগী ও রোগীর পরিবার যদি রোগীর স্বাস্থ্য রক্ষাসংক্রান্ত এবং রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে সজাগ থাকেন, তবেই নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে। বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস পালনও সার্থক হবে।
লেখক: ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্মাসিস্ট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক কনসালট্যান্ট