বেদনায় ভরা নীল টিপ
বেহুলা সুন্দরীর ঝুলে থাকা লাশ যখন নিচে নামাল, তখন তার পরনে ছিল নীল শাড়ি, হাতে কাচের চুড়ি, কপালে নীল টিপ। লাশ নামানোর সময়ও একটা চুড়ির সাথে অন্য চুড়ি লেগে এক মিষ্টি সুরের দ্যোতনা সৃষ্টি করছিল। কিন্তু তাতে ছিল বেদনার করুণ সুর। বেহুলা সুন্দরীর দুটি ছেলে-মেয়ে। বড়টি ছেলে, বয়স সাত। ছোট মেয়ের বয়স ৩। সব দুঃখ-কষ্টের জলাঞ্জলি দিয়ে বেহুলা অন্য জগতে পারাপার হলেও তার অবুঝ সন্তানদের কে দেখবে এখন?
লম্বাচওড়া, গায়ের রং দুধে আলতা, নাকটা খাড়া, চিকন একহারা গড়নের স্বর্গের অপ্সরী বললেও ভুল হবে না তাকে। আসল নাম-জাহানারা। কিন্তু যখন এ পাড়ায় তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়, তখন তাকে সবাই সুন্দরী বলেই ডাকা শুরু করে। সে থেকে জাহানারা সুন্দরী নামেই পরিচিতি লাভ করতে থাকে। মেয়েটিও কিছুটা মায়ের মতোই দেখতে হয়েছে। নাম অনামিকা। ছেলের নাম বাবু।
রহমতের অনাদর আর অবহেলার কারণেই কিছু ভেবে না পেয়ে আবার সন্তানদের নিয়ে পূর্বের জায়গায় ফেরত যায় বেহুলা।
একটি জেলা শহরের পল্লিতে যখন জাহানারা পোষা কবুতরের খোপে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনৈতিকতার মাকড়সার জালে বন্দী হয়, তখন এখান থেকে অনেক চেষ্টা করেছে বের হয়ে মুক্ত জীবনে ফিরতে। কিন্তু নিয়তির অমোঘ বিধানে যে তার সৌন্দর্যের পসরা নানাজনে ছিন্নভিন্ন করে খাবে। তাই আর ফেরা হয়নি মুক্ত বিহঙ্গে। বেহুলা সুন্দরী তাই সব সময়ই চাইত তাকে এখান থেকে কেউ উদ্ধার করে নিয়ে যাক। কত মানুষ আসে তার ঘাটে। তার রূপের সুধা পান করেই উড়ে যায়। কেউই তাকে গ্রহণ করতে রাজি হয় না। কিন্তু জেলা শহরে চুল কাটে রহমত ছিল তার রূপের নিয়মিত খরিদ্দার। বেহুলা সুন্দরীর কাছে রহমত কিছুই না। তারপরও রহমতের ভালোবাসায় বেহুলা সুন্দরী আর নিজেকে না করতে পারেনি। তার হাত ধরেই মনুষ্য সমাজে বসবাস শুরু করে বেহুলা সুন্দরী। প্রথম প্রথম রহমতের মা বাধা দিয়েছিল। রহমতকে উপহাস করেছিল। রহমতের পাড়ার অনেকেই ছি ছি করেছিল। কিন্তু রহমত তাতে কর্ণপাত করেনি। প্রথম কয়েকটি বছর রহমতের সাথে বেহুলা সুন্দরীর জীবনটা ভালোয় ভালোয় কেটেছিল। তখন জন্ম নেয় তাদের বড় ছেলে বাবু। তার তিন–চার বছর পর আবার আরেক মেয়ে কোলজুড়ে আসে। সবকিছু নিয়ে সামাজিকভাবে ভালোই জীবন চলছিল স্বামী রহমতকে নিয়ে বেহুলা সুন্দরীর।
কিন্তু সে ভালোবাসা আর বেশি দিন টেকেনি বেহুলা সুন্দরীর জীবনে। রহমত আস্তে আস্তে অন্যদিকে ঘুরপাক খায়। পাড়ার নতুন নতুন বসন্তের কোকিল খুঁজে নিয়ে সেখানকার জল পান করতে থাকে। তার আয়ের বেশির ভাগই রহমত নেশা আর নতুন নতুন প্রজাপতির পেছনে খরচ করতে থাকে। এ নিয়ে বিরাট দ্বন্দ্ব শুরু হয় রহমত আর বেহুলা সুন্দরীর সংসারে। আগের মতো বাজারসদাই—ঠিকভাবে করে না রহমত। বেহুলার জীবনে চাঁদের কলঙ্কের মতো দাগ থাকায় বেশি উচ্চবাচ্য করতেও পারে না বেহুলা সুন্দরী। সবকিছু নীরবে নিভৃতেই সহ্য করতে হয় তাকে। কিন্তু খোদার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। খাবারের অভাব, বাচ্চাদের লালন–পালন করতে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে বেহুলা সুন্দরী। মুক্ত আলোয় বের হয়েছিল বেহুলা সুন্দরী স্বাভাবিক জীবনের আশায়। কিন্তু তাকে প্রতি পলে পলে এতটা বিপর্যস্ত হতে হবে, তা সে তখন ভাবেনি কখনো। বাস্তবতার নিরেট সত্য এখন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। অন্ধ গলিতে যখন বেহুলা ছিল, তখন তাকে টানাপোড়েনের মধ্যে পড়তে হয়নি। হাতভর্তি টাকা ছিল। যখন যা মন চাইত তা কিনে খেত। তবে বেশি কিছুর চাহিদা ছিল না বেহুলার জীবনে। নতুন নতুন মানুষ ধরতে তখন একটু সাজগোজ করতে হতো। তবে বেশি সাজও তার লাগত না। প্রকৃতিগতভাবেই বেহুলা অনেক সুন্দর গড়নের ছিল। যখন তাকে এ পাড়ায় বিক্রি করে দেওয়া হয়, তখন সিরিয়াল দিয়ে কুলাতে পারত না বেহুলা। তবে প্রথম প্রথম বেশি মানুষ তার ঘরে বসাতে পারত না বেহুলা। আস্তে আস্তে সবকিছুই সয়ে গেছে তার কাছে। অনেক পুরুষ এসে বেহুলাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু তাদের কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেনি বেহুলা। জীবন ছন্দে যখন একাকী হয়ে পড়ত, তখন ডুকরে ডুকরে কাঁদত বেহুলা। তার গ্রামের নদীপাড়ের দৃশ্যটি বারবার মনে পড়ে। গ্রামের মেঠা পথ ধরে কখনো শর্ষের খেতে আল ধরে কত দৌড়াদৌড়ি করেছে বেহুলা। তা সবকিছুই এসে হানা দেয় এখন স্মৃতির মানস পটে। কিন্তু গ্রামে থাকতে তার মা মারা গেছে অনেক আগেই। একমাত্র বাবাই ছিল তখন তার আশ্রয়। কিন্তু রোগশোকে ভুগে সেই শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে বেহুলার জীবনে বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটে। তাদের গ্রামের একজন ঢাকায় কাজ দেবে বলে এখানে তাকে নিয়ে এসে বিক্রি করে দেয়। তার সুন্দর স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে আসতে থাকে। প্রথম দিকে অনেক কান্নাকাটি করত। এখান থেকে বের হওয়ার অনেক চেষ্টা করেও যখন বিফল হলো, তার পর থেকেই এ অন্ধ গলিতেই তার ঠাঁই স্থায়ী হলে গেল।
রহমতের অনাদর আর অবহেলার কারণেই কিছু ভেবে না পেয়ে আবার সন্তানদের নিয়ে পূর্বের জায়গায় ফেরত যায় বেহুলা। তাকে অন্ধ গলির বাসিন্দারা পেয়ে বাহবা দিতে থাকে। গলিতে গলিতে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। সবাই এসে ভ্রমরের খোঁজ করে। এখানে এসেও কয়েকটি বছর কেটে গেছে।
একদিন গভীর রাত। সেদিন কাউকে ঘরে বসায়নি বেহুলা সুন্দরী। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে। নিজে নিজেকে আয়নায় একবার দেখে নেয়। তারপর তার একহারা গড়নে, যাতে এখনো বলিরেখা পড়েনি। চোখের মায়াবী চাহনিটা এখনো অনেকের ঘুম কেড়ে নেওয়ার মতো। এত রূপের পসরা থাকার পরও জীবন সায়াহ্নে এসে নিজের সাথে আর পেরে উঠতে পারছে না বেহুলা সুন্দরী। তাই পূর্ণিমা রাতের গভীর জোছনায় নিজেকে সাজাতে বসে বেহুলা সুন্দরী। তার খাটে ফুটফুটে দুটো বাচ্চাকে চাঁদের আলোর মতোই যেন লাগছে তার কাছে। সে সাজে। লাল, নীল, কালো টিপ পরে কপালে। কোন টিপে তাকে ভালো লাগে, সে পরখ করে দেখতে চায়। অবশেষে নীল টিপই বেছে নেয় বেহুল সুন্দরী। হাতের কাচের চুড়ি রিনঝিন শব্দ করে উঠছে মাঝেমাঝে। পূর্ণিমার জোছনাও হেলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে। রাত ফুরিয়ে আসছে। তাকে আর দেরি করলে চলবে না। নীল টিপের সাথে একটা শাড়ি পরে আরেকটা শাড়ি পেঁচিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ে বেহুলা। বিদায় জানায় পৃথিবীর আলো-বাতাস। আর একরাশ ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়ে যায় মানুষের প্রতি।
সকালে বাচ্চা দুটোর কান্নায় চারদিকের মানুষ এসে ভিড় করে বেহুলার ঘরের কাছে। একে একে সবাই আসে। লাশ নিতে পুলিশ আসে। পাড়ার সবাইকে জিজ্ঞাসা করা হয়। তাতে কোনো কূলকিনারা পায় না পুলিশ। বেহুলা সুন্দরীর লাশ গাড়িতে ওঠায়। সে গাড়ির পেছনে পেছনে বাবু তার ছোট বোন অনামিকাকে কোলে করে নিয়ে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু গাড়ির সাথে আর পেরে ওঠে না বাবু। কাঁদতে কাঁদতে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে এসে থামে বাবু। তাদের কান্না দেখে দোকানদারের মায়া হয়। তারা তাদের মিষ্টি, পরোটা খেতে দেয়। খাবার পর বাবু বোনটাকে রেখে আবার মায়ের লাশের সন্ধানে দৌড়ায়। কিন্তু কোথায়ও কেউ নেই। সামনে জামালপুরের স্টেশনে ট্রেন দেখে তাতে উঠে পড়ে বাবু। সাত বছরের বাবু নীড়হারা হয়ে পড়ে। কমলাপুর স্টেশনে এসে নেমে কাঁদতে থাকলে একজন দয়াবান মানুষের হাতে পড়ে বাবু। জীবন বহতা নদীর মতো চলতে থাকে বাবুর জীবন। মাঝেমাঝে ঘুমের ঘোরে মাকে দেখে, বোনকে দেখে কেঁদে ওঠে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না সে। কোথায় বাড়ি, কোথায় ঘর। ২৮ বছর পর বাবু ফেসবুকের কল্যাণে খুঁজে পায় তার বাবা রহমত আলীকে। তার ছোট বোন অনামিকাকে। আর সবকিছুর আড়ালেই থেকে যায় জাহানারা ওরফে বেহুলা সুন্দরীর অতীত ইতিহাস।
*লেখক: অলিউর রহমান ফিরোজ, মিরাপাড়া, রিকাবীবাজার, মুন্সিগঞ্জ