তরুণ সমাজে ভাইরাল হওয়ার প্রতিযোগিতা কি ‘অসুস্থ’

ছবি: রয়টার্স

একটি সমাজ, জাতি বা দেশের সম্পদ বলতে বোঝানো হয় তরুণ মানবসম্পদকে। বলা হয়, তরুণেরাই ভবিষ্যৎ। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, একটি দেশ এবং সমাজের সার্বিক উন্নতির পেছনে সব থেকে বেশি অবদান থাকে তরুণদের। কিন্তু বর্তমানে সেই তরুণেরাই চাকচিক্যপূর্ণ ফিচারে ভরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ। অযথা নষ্ট করছেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার মূল্যবান মাহেন্দ্রক্ষণ। পিছিয়ে পড়ছেন তাঁদের জীবনের লক্ষ্য থেকে এবং বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব থেকেও।

সমীক্ষায় দেখা যায়, আমাদের দেশের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেসবুকই সব থেকে বেশি জনপ্রিয় একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আর এ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশ বয়সে তরুণ। তরুণদের কাছে নিজেদের ভাবনাচিন্তা তুলে ধরার জন্য এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম একটি সহজ প্ল্যাটফর্ম। তাঁরা প্রধানত এটাকে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেও এর বাইরে এর নেতিবাচক ব্যবহারও কম নয়।

একটি বেসরকারি পর্যবেক্ষণ বলছে, যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ফেসবুক ব্যবহার করেন, বিশেষ করে তরুণেরা, তাঁদের শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগই ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি বা অনুভূতি শেয়ার করেন। শেয়ার করে তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটাতে চান, অবস্থার জানান দিতে চান। তবে এটা করতে গিয়ে কেউ কেউ ভাষার ব্যবহার বা ছবি ও কনটেন্ট ব্যবহারে অসতর্কতার পরিচয় দেন, অথবা অসততা করেন।

ফেসবুক তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হওয়া সাম্প্রতিক আরও দুটি নতুন কারণ যুক্ত হয়েছে। আর তা হলো, ফেসবুক রিলস ও ফেসবুক ব্লগিং। রিলসে ১০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির শর্ট ভিডিও পোস্ট করে অধিক পরিমাণে ভিউ এবং ফলোয়ার বাড়ে। ফলোয়ার আর ভিউয়ের নেশায় পোস্ট করে অশালীন পোশাকে অশ্লীল ছবি, অঙ্গভঙ্গি বা ভিডিও কোনোটাই যেন বাদ নেই।

যা তরুণদের ভাইরাল হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে তুলছে। এমনও শুনতে পাওয়া যায়, সফলতার মাপকাঠি হচ্ছে, কার কত বেশি ফেসবুক ফলোয়ার। ভাইরাল হওয়ার এই প্রতিযোগিতায় মেয়েরাও শর্ট কাপড়ে ভিডিও পোস্ট করতে একচুল দ্বিধা বোধ করছেন না। আবার অন্যরা এই অশ্লীল ভিডিও দেখতে পার করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ সবকিছু তরুণদের মস্তিষ্ককে তৈরি করছে এককেন্দ্রিক নিচু মানসিকতায়, যেটা তরুণদের ধ্বংসের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে সাম্প্রতিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সামাজিক বিষয় নিয়ে আগে তরুণেরা যা ব্লগে লিখতেন, তা এখন ফেসবুক স্ট্যাটাসেই লিখে। সেখানে মন্তব্য আসে, পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক হয়।

বাংলাদেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাত কোটি। আর মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটিরও বেশি। ৭ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৬ কোটিই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন মুঠোফোনে। এই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রায় ৩ কোটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুক ব্যবহার করেন। ফেসবুক ব্যবহারকারী ৩০ ভাগ তরুণ অন্যকে নিয়ে মজা করেন বা পচায়। তাঁরা ট্রল করে অযথা সময় নষ্ট করেন। আর বাকিরা কথোপকথন আর বিভিন্ন ভিডিও দেখে সময় নষ্ট করেন। তবে এর বাইরেও ছোট একটি অংশ আছে, যাঁরা বেশ সিরিয়াস। তাঁরা ফেসবুকের মাধ্যমে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চান। এমনকি ফেসবুকে তাঁরা বানান নিয়েও কথা বলেন। তবে বাস্তব জীবনে তাঁরা এতটা অ্যাকটিভ নন। অল্পসংখ্যক আছেন, যাঁরা নানা সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। তাঁরা মূলত ফেসবুকে তাঁদের কাজের প্রচার চালান। তাঁরা বাস্তব জীবনে বেশি অ্যাকটিভ।

অন্যদিকে তরুণদের জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা আরও একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হচ্ছে টিকটক। ২০১৬ সালে চীনে টিকটকের জন্ম। অথচ সেই চীনেই এখন টিকটক নিষিদ্ধ। ২০২১ সালে প্লে স্টোরে সর্বাধিক ডাউনলোডের খেতাবটিও গেছে টিকটকের ঘরে। অশালীন অঙ্গভঙ্গি আর ব্যঙ্গাত্মক রম্য সংলাপের আড়ালে অশ্লীলতার এপিঠ আর ওপিঠ হলো টিকটক। গান কিংবা রম্য সংলাপের সঙ্গে নিজের ব্যঙ্গাত্মক মুখভঙ্গি আর ঠোঁট মিলিয়ে ১৫ থেকে ৬০ সেকেন্ডের ভিডিও বানানোর নাম টিকটক। বেডরুম, বাড়ির ছাদ, স্কুল-কলেজের আঙিনা—কোনো স্থানই বাদ নেই টিকটকারদের হাত থেকে। সময়-অসময় টিকটকের এই খেলায় মেতে আছে উল্লেখযোগ্য তরুণ সমাজ। শরীরের বিশেষ অংশ প্রদর্শন, অদ্ভুত ও অযৌক্তিক সংলাপ, গুজব বা উদ্ভট চুলের প্রদর্শনসহ নানা রকম পাগলামির মাধ্যমে কে কত ভিউ আর ফলোয়ার বাড়াতে পারেন, তার এক অঘোষিত অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

তবে অতিমাত্রায় টিকটকের ব্যবহার একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি প্রতিবেদনে বলছে, এসব আসক্তি একটা মানসিক রোগ। সেটা মদে আসক্তি হোক, আর টিকটকে আসক্তিই হোক। এটাকে বলা হয় আচরণগত আসক্তি। তাই তাদের সুস্থ করতে হলে উপযুক্ত চিকিৎসা করাতে হবে। মনোচিকিৎসা ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাদের সুস্থ করা সম্ভব। একই সঙ্গে তাদের মা-বাবারও আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। সবাই মিলে একসঙ্গে চেষ্টা করলে তাঁদের সবাইকে সুস্থ করা সম্ভব।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই অবাধ ব্যবহার বর্তমানে তরুণদের কুক্ষিগত করে রেখেছে তাদের বাস্তবিক চিন্তা ও নিজের ভবিষ্যৎ জীবন থেকে। অধিক পরিমাণে অযাচিত সময় নষ্ট করায় ঝরে পড়েছে নিজেদের লক্ষ্য থেকে হচ্ছে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন, যা আগামী প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছে এক অজ্ঞতার অন্ধকার যুগে। এ সামাজিক ব্যাধিকে রুখতে এবং তরুণের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবকদের। সচেতন হতে হবে খোদ টিকটকারদেরই। কারণ, তরুণেরাই পারে আগামী প্রজন্মকে গতিময় থেকে গতিশীল করতে।

লেখক: নাজিম হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।