‘শীতের বুড়ি’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সাজ্জাদ সায়মার ফুটফুটে দুটি ছেলে-মেয়ে শাহজাদা আর সুজাতা। সাজ্জাদের সাত আর সুজাতার বয়স পাঁচ বছর চলছে এখন। খুব মিষ্টি দেখতে ওরা দুই ভাই–বোন। যেমন চটপটে, তেমনি হাসিখুশি। সাজ্জাদের দেশের বাড়ি সিলেট। বেশ অবস্থাপূর্ণ ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান সে। ঢাকায় জব করার সুবাদে ফ্যামিলি নিয়ে এখন সে ঢাকায় থাকে। কয়েক দিন আগে শাহজাদা আর সুজাতার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আর তাই শীতের ছুটিতে ওরা মা-বাবার সঙ্গে যশোরে ওদের নানুবাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে। সেই আনন্দে ওরা দুই ভাই–বোন একসঙ্গে কবি ফারুক আহম্মেদ জীবনের লেখা ‘শীতের বুড়ি’ নামক মিষ্টি ছড়া কাটছে হেসে হেসে অঙ্গভঙ্গি করে হাত, চোখ, মুখ নেড়ে নেড়ে...।

শীতের বুড়ি এল এবার

দিয়ে হামাগুড়ি,

মিঠে পিঠা খাব রসের

খাব যে গুড়–মুড়ি,

খাব আরও পিঠাপুলি

খাব রসের পায়েস,

নানুর মুখে গল্প শুনব

করে ভীষণ আয়েশ।

দেখব গ্রাম ঘুরে ঘুরে

নানুর হাতটি ধরে,

শুভ্র শিশির মাখব পায়ে

মনটা যাবে ভরে।

নানুবাড়ি যাব আমরা

চড়ে ট্রেন গাড়ি,

সঙ্গে নেব নানির জন্য

রসমালাই হাঁড়ি।

দেখে নানি আমাদের যে

কি যে খুশি হবে,

মটরশুঁটি খেয়ে আমরা

ফিরব ঢাকায় তবে।

সাজ্জাদ তাদের দুই ভাই-বোনের অমন আনন্দ করে ছড়া কাটতে দেখে বলল...কী ব্যাপার! তোমাদের দেখছি নানুবাড়ি যাবে বলে খুব আনন্দ লাগছে?

ওরা, দুই ভাই–বোন বলল...হুম ভীষণ আনন্দ লাগছে আব্বু। কত দিন পর নানুবাড়ি যাচ্ছি...।

ওদের মা, সায়মা এসে বলল...বুঝতে পারছ না ওখানে নানা-নানির আদর পাবে। একটু বাঁদরামি করে ঘুরে বেড়াতে পারবে গায়ের মাঠে। শীতের মিষ্টি খেজুর রস, পিঠা খেতে পারবে। আর

ও কত কি....সাজ্জাদ বলল... হুম বাচ্চারা নানা-নানিকে কাছে পেলে তো একটু বেশি আনন্দ করবেই। নাও চলো তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরতে হবে।

সায়মা বলল...হুম চলো। তারপর সকলে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে...।

ওদের নানা প্রতাপ চৌধুরী একজন এলাকার বেশ গণ্যমান্য সম্মানি লোক। যেমন তার প্রভাব পতিপত্তি তেমনি প্রতাপশালী। লোকমুখে শোনা যায় একসময় নাকি চৌধুরীর বংশের পূর্বপুরুষেরা জমিদার ছিল। যদিও এখনো প্রচুর ধনসম্পদ জায়গাজমি রয়েছে চৌধুরীর। তার স্ত্রী মিনতি চৌধুরী খুব পর্দাশীল মহিলা। দুপুরের একটু আগে সাজ্জাদ পরিবার নিয়ে যশোর পৌঁছাল। জামাই–মেয়ে নাতি–নাতনি আসবে সংবাদটা পেয়ে চৌধুরী আগেই গাড়ি পাঠিয়েছে স্টেশনে ওদের আনতে। ওরা সব ট্রেন থেকে নামতেই ওদের সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। সবাই সে গাড়িতে ওঠে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের নিয়ে গাড়ি এসে পৌঁছাল বাড়ি। গাড়ির শব্দ শুনে চৌধুরী, স্ত্রী রাবেয়া চৌধুরী ও বাড়ির অন্য অন্য লোকজন গাড়ির কাছে ছুটে এল। সাজ্জাদ সায়মা গাড়ি থেকে নেমে সালাম করে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে কদমবুসি করল চৌধুরী আর তার স্ত্রী মিসেস চৌধুরীকে। শাহজাদা সুজাতা দুই ভাইবোনও ওদের নানা-নানিকে সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করল।

প্রতাপ চৌধুরী সুজাতাকে, আর চৌধুরী শাহজাদাকে আদর করে কাছে টেনে নিল। চৌধুরী কাজের লোক রাজনকে ডেকে বলল জাল ফেলে পুকুর থেকে বড় মাছ ধরতে। বাড়ির কেউ কেউ মিষ্টির প্যাকেট আর ওদের সঙ্গে আনা ব্যাগ গাড়ি থেকে নামিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। চৌধুরী আর চৌধুরীর স্ত্রী বহুদিন পর ছোট ছোট দুটি দুষ্টু-মিষ্টি নাতি-নাতনি আর মেয়ে জামাতাকে একসঙ্গে পেয়ে খুব খুশি। দুপরের লাঞ্চের পর বিকেল বেলা শাহজাদা আর সুজাতা ওদের নানার সঙ্গে গায়ে একটু ঘুরতে বের হলো গ্রাম দেখার জন্য। বেরুনোর সময় ওদের নানি মিনতি চৌধুরী স্বামী প্রতাপ চৌধুরীকে ডেকে বলল...ওগো, শুনছো...কাল সকালে কিন্তু করিমকে খেজুরের রস দিতে বলো কেমন। তারপর শাহজাদা আর সুজাতার দিকে তাকিয়ে বলল...

আমার নানুভাইয়েরা এসেছে। ওদের যে খেজুরের মিষ্টি রসের পিঠে খাওয়াতে হবে। চৌধুরীও হেসে বলল...আচ্ছা ঠিক আছে... বলব। আমার নানুভাইয়েরা শীতের সকালে খেজুরের মিষ্টি রস খাবে। জিরেন কাঠের মিষ্টি রসের পিঠে খাবে...।

আর আমি বলব না! সেটা কী করে হয় বলতো? আজই বলে দেব করিমকে, ঠিক আছে। চৌধুরী হেসে বলল: হুম ঠিক আছে, যাও। সে সময় শাহজাদা আর সুজাতার মা, মানে চৌধুরীর মেয়ে সায়মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল: আব্বা...কোথাও যাচ্ছেন নাকি? প্রতাপ চৌধুরী বলল: হ্যাঁ মা, আমার নানুভাইদের নিয়ে একটু গ্রাম ঘুরতে বের হচ্ছি। কেন...কিছু বলবি মা? সায়মা বলল: না এমনি জিজ্ঞাসা করছি আব্বা। প্রতাপ চৌধুরী বললো: ও আচ্ছা.।

সে সময় চৌধুরীর জামাতা সাজ্জাদ বলল..যাক। শহরে তো কোথাও মুক্ত জায়গা নেই।একটু গাঁয়ের খোলামেলা সবুজ পরিবেশে ঘুরে আসুক। চৌধুরী বলল...জামাই বাবাজি ঠিক বলেছে মা। গ্রামের মতো চোখজুড়ানো সবুজ প্রকৃতি আর বেঁচে থাকার জন্য নির্মল বিশুদ্ধ অক্সিজেন কি শহরে পাওয়া যায়? নানা ফুল, পাখিদের মিষ্টিমধুর গান। সায়মা বলল...জি, আব্বা ঠিক বলেছেন।

তারপর, শাহজাদা আর সুজাতার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাঁয়ের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে লাগল চৌধুরী। আর চলার পথের এদিক–সেদিক তাকিয়ে হাত ইশারা করে গাঁয়ের সবুজ ফসলের মাঠ সিম, মটরশুঁটি, সবজিখেত এসব দেখাতে লাগল নাতি-নাতনিদের... হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ! করিমের সঙ্গে পথে দেখা হয়ে গেল চৌধুরীর।

তখন পড়ন্ত লালিমা গোধূলিবেলা। করিম তখন তার খেজুরগাছগুলো কেটে বাড়ি ফিরছিল। মাজায় ঠুঙ্গি বাঁধা রয়েছে। কাঁধে রয়েছে বাগ। বাগের দুই পাশে দুটো ভাড়ও ঝুলছে। করিম চৌধুরীকে দেখেই সালাম দিল। আসসালামু আলাইকুম চৌধুরী সাহেব। চৌধুরী সাহেব কেমন আছেন? চৌধুরী সালামের উত্তর দিল...ওয়ালাইকুম আসসালাম। তারপর চৌধুরী বলল..

আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।

তুমি কেমন আছো করিম মিয়া? বউ ছেলেমেয়ে সব কেমন আছে? করিম প্রত্যুত্তরে বলল...জি, আলহামদুলিল্লাহ, আমরা সবাই ভালো আছি। চৌধুরী বলল, যাক বেশ ভালো আছ জেনে খুশি হলাম। আচ্ছা শোনো করিম মিয়া। করিম মিয়া বলল: জি, বলেন চৌধুরী সাহেব। চৌধুরী বললো, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হলো। তোমার চাচি বলছিল...কাল সকালে আমার বাড়িতে দুই ভাড় খেজুরের রস দিয়ে আসতে। দিয়ে এসো কিন্তু কেমন। আমার নানু ভাইয়েরা এসেছে শহর থেকে। ওদের যে এই শীতের মিষ্টি খেজুরের রস। গরম-গরম ভাপা পুলি, পাটিসাপটা আর রসের পায়েস খাওয়াতে হবে।

করিম বলল..জি, চৌধুরী সাহেব তা তো বটেই, তা তো বটেই। তারপর...করিম, শাহজাদা আর সুজাতার দিকে তাকিয়ে বলল...তা, নানু ভাইয়েরা ভালো আছ তো তোমরা? শাহজাদা আর সুজাতা হেসে ঘাড় নেড়ে বলল জি, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো? করিমও হেসে ওঠে বলল...আলহামদুলিল্লাহ আল্লার রহমতে ভালো আছি।

তারপর বলল...চৌধুরী সাহেব, চিন্তা করবেন না, আমি আগামীকাল সকালেই রস পৌঁছে দেব আপনার বাড়িতে। চৌধুরী বলল...আচ্ছা ঠিক আছে। এবার তাহলে তুমি যাও করিম মিয়া...। এমনিতেই গাছ কেটে তোমার অনেক কষ্ট হয়ে গেছে। করিম মিয়া বলল: জি, চৌধুরী সাহেব তাহলে আসি। তারপর সালাম দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল...। চৌধুরীও সালামের জবাব দিয়ে নাতি-নাতনিদের নিয়ে হাঁটতে লাগল আর বিভিন্ন ডোবা-পুকুর গাছপালা -পাখপাখালি দেখাতে লাগল। একসময় সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়তেই মাগরিবের আজান শুরু হলো। চৌধুরী শাহজাদা আর সুজাতাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল। বাড়ি ফিরে অজু সেরে চৌধুরী নামাজ পড়তে গেল মহল্লার মসজিদে। রাতে একসঙ্গে সব ডিনার করতে বসল ডাইনিং টেবিলে। খাওয়ার সময় একপর্যায় চৌধুরী জামাই সাজ্জাদকে জিজ্ঞাসা করল...তা- জামাই বাবাজি তোমার জব কেমন চলছে? সাজ্জাদ খাওয়ার ফাঁকে বলল...জি, ভালো চলছে আব্বা। মিসেস চৌধুরী বড় মাছের মাথাটা জামাইয়ের প্লেটে দিয়েছে। মাছের তরকারি খাওয়ার পর খাসির মাংস রান্না তুলে দিলো জামাই সাজ্জাদের প্লেটে। মিসেস চৌধুরী আবার মাংস দিতে যাবে সে সময় সাজ্জাদ বলল...থাক...থাক...আম্মা, আর খেতে পারব না। চৌধুরী বলল...তাই বললে হয় বাবা..আর একটু নাও...বলে আবার চামচে কয়েক পিচ মাংস তুলে দিল। খাওয়াদাওয়ার পর সবাই কিছুক্ষণ গল্প করে ঘুমাতে গেল। পরের দিন সকালে করিম মিয়া খেজুরের রস নিয়ে এল। চৌধুরী নানা রকম শীতের মিষ্টি খেজুরের রসের পিঠে বানাই খাওয়া মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনির। এক সপ্তাহ বেশ আনন্দে কাটল শাহজাদা আর সুজাতার স্কুল ছুটির দিনগুলো ওদের নানু বাড়িতে। তারপর একসময় ওরা নানুবাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার নিজেদের বসবাসের গন্তব্য স্থলে রওয়ানা দিলো ঢাকায়।