বর্তমান বাংলাদেশের নতুনের সম্ভাবনা

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে তৈরি হয়েছে বিপুল জন–আকাঙ্ক্ষা, সূচিত হয়েছে সম্ভাবনার নতুন পথ। ৩ জুলাই ২০২৪ছবি: সাজিদ হোসেন

বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধশালী ইতিহাসের দেশ। দীর্ঘদিনের সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন, উন্নয়নের পথে নানা বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া ও মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা—সবকিছুই আমাদের ইতিহাসের অংশ। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের রাজনীতিতে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। সবশেষ সরকারের শাসনের যাঁতাকলে মানুষ একসময় নিজস্ব অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সুষ্ঠু নির্বাচন থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।

একটি ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের পর স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। মানুষভাবে এবার তারা একটি নতুন দেশ গড়তে পারবে, যেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় প্রত্যাশার চেয়ে ভিন্ন হয়। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই নতুন শুরুর সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান।

কেন নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা সীমিত হতে পারে

১. রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্থবিরতা

বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুই প্রধান দলের প্রতিযোগিতায় বন্দী। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি দুষ্টচক্র তৈরি করেছে, যেখানে ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো সমস্যাগুলো থেকে যায় এবং নতুন সমস্যা তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতার অভাব ও প্রতিহিংসার রাজনীতি উন্নয়নের পথে বড় বাধা।

২. দুর্নীতি ও স্বার্থান্বেষী মনোভাব

দুর্নীতি বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা। এটি প্রশাসনিক কার্যক্রম, বিচারব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে দুর্বল করে। ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের পরও যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

৩. প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে আরেকটি বড় বাধা। বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সংস্থাগুলো যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়ে।

৪. জনসংখ্যার চাপ ও শিক্ষার অভাব

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এই জনসংখ্যা একদিকে শক্তি হলেও অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার অভাবের কারণে এটি একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। সঠিক শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন ছাড়া জনশক্তি সম্পদে রূপান্তর সম্ভব নয়।

৫. জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ

বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য প্রভাব অর্থনীতির ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে। এই প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন, যা অনেক সময় অবহেলিত থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনী ও নীলফামারী এর সাক্ষী।

৬. অর্থনৈতিক বৈষম্য

বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি দেখেছে, তবে এই প্রবৃদ্ধি সমানভাবে সবার মধ্যে বিতরণ হয়নি। গ্রামীণ এলাকাগুলো এখনো পিছিয়ে আছে এবং শহরের মধ্যবিত্তের বাইরে বড় একটি অংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে।

এখন প্রশ্ন আসবে, নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা কী সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে, যেমন

১. রাজনৈতিক সংস্কার

রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ছাড়া উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা, সহনশীলতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করে একটি সমন্বিত ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক করতে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

৩. শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন

শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা কেবল সার্টিফিকেট অর্জনের দিকে নয়, বরং দক্ষতা ও সৃজনশীলতার উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়। প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বাড়ানোর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে কর্মক্ষম করতে হবে।

৪. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও শিল্পায়ন

দেশের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করতে হবে। কেবল গার্মেন্টস শিল্পের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্টার্টআপ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

৫. পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন

পরিবেশ রক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার, সবুজ শিল্পায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

৬. সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমান সুযোগ

সমাজের প্রতিটি অংশের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে ও নারীর ক্ষমতায়ন বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের মানুষ একটি নতুন সূচনার স্বপ্ন দেখছে। একটি ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন তাদের জন্য একটি নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছে। তবে এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে হলে শুধু আশা নয়, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, রাজনৈতিক সচেতনতা ও দূরদর্শী নেতৃত্ব প্রয়োজন। প্রত্যেক নাগরিককে তাঁর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে নতুনভাবে চিন্তা করার, নতুন করে দেশ গড়ার। আমাদের লক্ষ্য একটি উন্নত, গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ—যেখানে প্রত্যেক নাগরিক তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবেন।

*লেখক: এহসানুল হক শিহাব, ২য় বর্ষ, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা