নতুন পথচলায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত: সংস্কার, সাশ্রয় ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার
বিদ্যুৎ আধুনিক সভ্যতার চালিকাশক্তি। এটি কেবল আমাদের ঘরবাড়ি আলোকিত করে না; বরং দেশের শিল্প, অর্থনীতি ও প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। তবে দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিদ্যুৎ খাত ছিল নানা অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা ও আর্থিক সংকটের জালে আবদ্ধ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এ গুরুত্বপূর্ণ খাতকে ঢেলে সাজানোর জন্য একগুচ্ছ সাহসী এবং সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ বিধান আইন রহিত করা থেকে শুরু করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে জোর দেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি সিদ্ধান্তই প্রমাণ করে যে বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ খাতকে একটি জনমুখী, নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেশের বিদ্যুৎ খাতের ওপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে।
বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ রহিত করা। এই আইন রহিত করার মাধ্যমে সরকার বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার দৃঢ়প্রত্যয় দেখিয়েছে। এই আইনের অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ ও একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও কার্যকর ও স্বচ্ছ চুক্তি সম্পাদনে সহায়ক হবে। পাশাপাশি, বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে একটি সার্বিক সংস্কার কমিটিও গঠন করা হয়। এই কমিটি ‘পলিসি ফর এনহ্যান্সমেন্ট অব প্রাইভেট পার্টিসিপেশন ইন দ্য পাওয়ার সেক্টর, ২০২৫’ নামে একটি খসড়া নীতি তৈরি করেছে, যা বর্তমানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামতের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। এই দুটি পদক্ষেপই বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সরকারের সামগ্রিক সংস্কারের চিত্র তুলে ধরে।
সরকারের আর্থিক সাশ্রয় ও বিদ্যুৎ খাতের স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা এবং ব্যয় সাশ্রয়ের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভর্তুকির চাহিদা ৪৭ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা দেশের অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করবে। এই লক্ষ্য পূরণে আইএমএফের সহায়তায় একটি রোডম্যাপ তৈরির কাজ চলছে। একই সঙ্গে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাবিউবোর জন্য ১০ শতাংশ ব্যয় হ্রাসের পরিকল্পনা, যা ইতিমধ্যে আগস্ট ২০২৪ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে। তরল জ্বালানি আমদানির সার্ভিস চার্জ ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ৪৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ কম নির্ধারণ ও ১০টি মেয়াদোত্তীর্ণ ও পুরোনো আইপিপি/রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে যথাক্রমে ২ হাজার ৫০০ কোটি ও ৫২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ট্যারিফ কমানোর মাধ্যমে ২ হাজার ৬৩০.৩১ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর জন্য ৬ শতাংশ উৎসে কর কমানোর অনুরোধ এবং এলএনজি আমদানির জন্য বাবিউবোর ভর্তুকির অর্থ থেকে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা জ্বালানি বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব আর্থিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারি কোম্পানিগুলোর মুনাফা ও বোনাস স্থগিত রাখা এবং পরিচালনা পর্ষদ সভার সম্মানির হার অভিন্নকরণের মাধ্যমে সরকারের অর্থ সাশ্রয় নিশ্চিত করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ২০২৫’ অনুমোদিত হয়েছে এবং এ বছরের ১৬ জুন গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে, যা এই খাতের জন্য একটি কার্যকর রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে। এই নীতির আলোকে, ‘জাতীয় রুফটপ সোলার কর্মসূচি’ হাতে নেওয়া হয়েছে, যার লক্ষ্য হলো ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারি অফিস, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করে জাতীয় গ্রিডে ২০০০ থেকে ৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। এ ছাড়া সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চারটি ধাপে ৫৫টি স্থানে ৫ হাজার ২৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার জন্য উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কাজ চলছে। পরিবেশদূষণ কমাতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে, যা একই সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং গ্রাহকদের ভোগান্তি কমানোর লক্ষ্যে গ্রীষ্মকালীন, রমজান ও সেচ মৌসুমে লোডশেডিংমুক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল। একই সঙ্গে গ্রাহক হয়রানি কমাতে এবং বিদ্যুৎ–সংযোগ প্রক্রিয়া সহজ করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম আরও সহজ করার জন্য কাজ করছে এবং এ বিষয়ে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। সরকার বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায় ও পরিশোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ বকেয়া ১,৭২,৭৯৪.৩ মিলিয়ন টাকা এবং বৈদেশিক বকেয়া ১৫২.৬৯ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে। বকেয়া বিল আদায়ের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যার ফলস্বরূপ এর মধ্যে ৮১৩.৫৭০২ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে।
ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এবং বিদ্যুৎ খাতকে শক্তিশালী ও টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২৩ জুলাই ২০২৫ তারিখে ১৬ হাজার ৭৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি, যা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকারের সক্ষমতা প্রমাণ করে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিদ্যুতের চাহিদা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে লোড ফোরকাস্টের নির্ভুলতা বাড়াতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা নিয়মিতভাবে চাহিদা পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ খাতে যে বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তার ফলাফল এরই মধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। এই সরকারের কার্যক্রম কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এর মূল লক্ষ্য ছিল বিদ্যুৎ খাতের সামগ্রিক সংস্কার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। বিতর্কিত আইন রহিত করা, আর্থিক অপচয় রোধে ভর্তুকি ও ব্যয় কমানোর মতো সাহসী সিদ্ধান্তগুলো প্রমাণ করে যে সরকার একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্বারোপ; যেমন ‘জাতীয় রুফটপ সোলার কর্মসূচি’ ও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগগুলো দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড স্থাপন এবং গ্রাহকসেবা সহজ করার প্রচেষ্টাগুলো জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা প্রকাশ করে। সব মিলিয়ে এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে একটি শক্তিশালী, নির্ভরযোগ্য ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে চালিত করবে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অপরিহার্য।
লেখক: বিসিএস তথ্য ক্যাডার এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]