মানুষের পৃথিবীতে আমিই রোকেয়া
এবার রোকেয়া দিবসে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘আমিই রোকেয়া’ লেখা প্ল্যাকার্ড সামনে দাঁড়িয়ে রেখে ছবি তুলেছেন। দেখতে দারুণ লেগেছে। আমাদের নারীরা ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছেন। একই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক সহযোগী অধ্যাপক তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স হ্যান্ডলে বেগম রোকেয়ার প্রতি চরম বিষোদ্গার ঢেলে দিয়েছেন। ধর্মকে জুজু মেনে নারীবিদ্বেষের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষকের বিষোদ্গার মানুষ হিসেবে মহত্তম অভিধায় অভিষিক্ত আমাদের মহানুভবতা ও মনুষ্যত্ব ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। তিনি প্রমাণ করেছেন থিওলজিস্ট দিয়ে ফিজিক্সের টিচিং কখনোই চলতে পারে না।
সায়েন্স এবং থিওলজির বৈপরীত্য আজকের নয়। কাল কালান্তরে চলমান এই সংঘাতকে উসকে না দিয়ে দুইটাকে দুই পাশে থাকতে দিলে কারোরই কোনো মাথাব্যথার কারণ হয় না। আন্তরিক ধর্মাচার তথা অধ্যাত্মবাদ নীরব ও নিভৃতির। অন্যবিধ নীতি ও শাস্ত্রের সঙ্গে তুল্যমূল্যে যাচাই করলে হিসাবে গড়বড় হবেই। বিশ্বাস আর যুক্তি একপাল্লায় মাপা যায় না। পৃথিবীতে ধর্মের সংখ্যা অন্তত ৪৩০০ এবং ৪২৯৯ ধর্মের মানুষই মুসলিমদের কাছে কাফির। তাহলে ওই কাফিরদের জগতে পদার্থবিজ্ঞানের ওই নামধারী শিক্ষক নিজেকে দেখতে চান কি না? বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বমানবিক বৈশ্বিক নীতি ও নৈতিকতা ওই শিক্ষক ধারণ করেন কি না? তাঁকে যদি মানুষের শিক্ষকতা পেশায় রাখি—এই প্রশ্ন আমাদের করে যেতেই হবে।
পদার্থবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক বা একজন পদার্থবিজ্ঞানীর মূল কাজ হলো প্রকৃতির নিয়ম ও আচরণকে স্পষ্টভাবে বোঝা এবং অন্যকে বোঝানো। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আলো, তাপ, বিদ্যুৎ, বল, শক্তি ও মহাবিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাকে সহজ ও যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করেন। এ জ্ঞানকে প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও বাস্তব সমস্যার সমাধানে প্রয়োগ করা, শিক্ষার্থীর কৌতূহল জাগিয়ে তোলা, বিজ্ঞানচেতনা ও যুক্তিবাদী মন গঠন করা এবং গবেষণা, সত্য অনুসন্ধান ও যথার্থতার প্রতি সম্মান শেখানোই তাদের প্রধান দায়িত্ব।
তাহলে একজন পদার্থবিদ বা physicist যদি ধর্মতত্ত্ব বা theology নিয়ে পড়ে থাকেন -ব্যাপারটা কেমন হবে? বাইবেল বলে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে। আর physics বলে ‘The Earth revolves around the Sun.’
বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলিকে রোমান ক্যাথলিক চার্চ পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে এমন হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্ব সমর্থনের কারণে ধর্মীয় আদালতে তলব করা হয়েছিল এবং তার বই প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আদালত তাঁকে গুরুতর শাস্তি না দিয়ে জেল এবং ‘ভয়াবহ অনুশোচনা’ শপথ নিতেও বাধ্য করেছিলেন। বাকি জীবন তিনি ঘরে বন্দী অবস্থায় কাটান।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পথিকৃৎ গ্যালিলিও গ্যালিলি তৎকালীন ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের তরফে চরম চাপ থাকা সত্ত্বেও অন্ধভাবে চার্চের পক্ষাবলম্বন না করে তিনি বৈজ্ঞানিক যুক্তির নিরিখে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন এবং চার শ বছর পরে হলেও ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
ওই ঘটনার পর প্রায় ৪০০ বছর পর, ১৯৯২ সালে পোপ জন পল দ্বিতীয় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন যে গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে চার্চের রায় ভুল ছিল এবং বৈজ্ঞানিক সত্যকে অবহেলা করা হয়েছে।
প্রথম আলো জানাচ্ছে, ‘নারী জাগরণ ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে ‘মুরতাদ কাফির’ আখ্যা দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। মঙ্গলবার সকালে তাঁর ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট শেয়ার করে ক্যাপশনে তিনি এ আখ্যা দেন। তাঁর মন্তব্যকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
ওই শিক্ষকের নাম খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। গতকাল বেগম রোকেয়া দিবসে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট শেয়ার করে তিনি লিখেছেন, ‘আজ মুরতাদ কাফির বেগম রোকেয়ার জন্মদিন।’ ওই শিক্ষক সাজিদ হাসান নামের ফেসবুক আইডির যে পোস্টটি শেয়ার করেছেন, তা মূলত বেগম রোকেয়ার রচনাবলি থেকে ইসলাম-সম্পর্কিত বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড অংশ তুলে ধরা হয়েছে। এই স্ট্যাটাস ঘিরে ক্যাম্পাসজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।'
মাহমুদুল হাসানের পোস্টের স্ক্রিনশট শেয়ার করে রাকসু নির্বাচনের বিতর্ক ও সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক পদের প্রার্থী মামুনুজ্জামান স্নিগ্ধ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই ভদ্রলোক যে বিভাগে শিক্ষকতা করেন, ওই একই বিভাগে নারী শিক্ষকও আছেন, কেমব্রিজপড়ুয়া ম্যামও আছেন। অনেক সনাতন মেয়েশিক্ষার্থী আছেন, হিজাব ব্যবহার করেন না—এমন শিক্ষার্থী আছেন। কিংবা ওনার মত-পথের বিরুদ্ধের মানুষ আছেন। এসব মানুষ কি আদৌও সব নারীশিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ? কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সঙ্গে কি নিরাপদ?’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক ও আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মাসুদ রানা লিখেছেন, ‘এই ধরনের মানুষ কীভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারে?’
এ বিষয়ে ওই শিক্ষক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যে পোস্টের ক্যাপশনে আমি এটি লিখেছি, সেই পোস্টেই বিস্তারিত সব ব্যাখ্যা আছে। আমার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে চাইলে কোনো ভালো আলেমের কাছে জানতে পারেন।’
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘ফেসবুকে অনেকেই অনেক কিছু লেখেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত মতামত। এ ধরনের বক্তব্য বর্তমান প্রশাসন সমর্থন করে না। কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জানালে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’
ওই শিক্ষক ২০১৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পথিকৃৎ গ্যালিলিও গ্যালিলি তৎকালীন ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের তরফে চরম চাপ থাকা সত্ত্বেও অন্ধভাবে চার্চের পক্ষাবলম্বন না করে তিনি বৈজ্ঞানিক যুক্তির নিরিখে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন এবং চার শ বছর পরে হলেও ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
আমরা বিশ্বাস করি পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান এই গ্যালিলিওকে খুব ভালোভাবে চেনেন এবং তাঁর থিওরি মুখস্থ না করে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে পারেননি। মুশকিল হলো পরীক্ষায় গ্যালিলিও পাঠের মাধ্যমে ভালো রেজাল্ট করে নিজের জীবিকা অনুসন্ধান করেছেন ঠিকই কিন্তু মগজটা রেখে দিয়েছেন প্রাগৈতিহাসিক ধ্যানধারণায়। এই শিক্ষক তাঁর কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখা গ্যালিলিওকে এতটুকু মনে না রেখে পড়ে রয়েছেন এমন এক মহীয়সী নারীর পেছনে যাঁর নামে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশের দিবসের নাম রাখা আছে। যার চিন্তা-চেতনা ও দর্শন বাংলাদেশ, ভারতসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে একাডেমিক্যালি পাঠ্য।
ক্রমাগতভাবে পিতৃতান্ত্রিক ঘেরাটোপ নারীকে কোণঠাসা করে রাখবার সময় শত বছর আগে বেগম রোকেয়া যদি নারীদের জাগিয়ে না দিতেন তবে শিক্ষক মাহমুদুল হাসানের মাও পড়ালেখা জানতেন না। আর মা যদি শিক্ষিত না হতেন মিস্টার হাসানের মতো পুরুষেরা শিক্ষক তকমায় অভিষিক্ত হতে পারতেন না। অথচ তিনি এমন মানুষদের পক্ষ নিলেন যারা কি না নারীকে পুরুষ পদবাচ্যেই বিবেচনা করেন না।
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুর পরে বেগম রোকেয়াকে কবরস্থানে কবর দিতে দেয়নি অন্ধ ধর্মগুরুরা। সারা দিন স্বজনেরা লাশ নিয়ে ঘুরেছেন কলকাতা ও আশপাশের কবরস্থানগুলোয়। সব জায়গাতেই বাধা এসেছে। অবশেষে সোদপুরে সোহরাওয়ার্দীদের একটি গুদামের উঠোনের এক কোণে গোপনে কবরস্থ করা হয় তাঁকে।
এ জন্যই আধুনিককালের বিশ্লেষকেরা বলেন, বেগম রোকেয়ার জীবনমৃত্যু শিখিয়েছে বাঙালি মুসলমানের মানুষ হয়ে উঠতে আরও শত শত বছর লাগবে। কদিন আগে গণবুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার ধর্মীয় ফ্যাসিজম নিয়ে আলাপ দিয়েছেন। রোকেয়া দিবসে আমরা এর স্বরূপ পুনর্বার স্বচক্ষেই দেখতে পেলাম।
এই উপমহাদেশে কাপুরুষোচিত আধিপত্যবাদ ভেঙে দেওয়ার প্রথম অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। এরপর যারা নারী ও পুরুষ সমভিব্যাহারে মানুষের জাগরণের আলাপ দিয়েছেন তারা প্রায় সবাই বেগম রোকেয়ার অনুবর্তী ও অনুসারী। কাজেই পুরুষতন্ত্রের প্রতিভুদের বেগম রোকেয়াকে ভালো লাগবে না—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার নিজে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বলছে—আমিই রোকেয়া; তখন এই রোকেয়াকে বাতিল করবেন কোন মুখে?