হেমন্তের ধান ওঠে, ফলে-দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে
‘হেমন্তের ধান ওঠে ফলে–/দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে’ জীবনানন্দ দাশের (জন্ম: বরিশাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯- মৃত্যু: কলকাতা, ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪) একটি কবিতার অংশ। হেমন্ত জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঋতু। হেমন্ত শব্দ ও হেমন্ত ঋতুর পরিবেশ, প্রতিবেশ নিয়ে অনেক ছত্র লিখেছেন। সমর সেনরা যখন নগরজীবন নিয়ে লিখছেন, তখন জীবনানন্দ লিখেছেন জীবজন্তু, নদী ও গাছপালার জগৎ নিয়ে। কবিতায় এসে যাচ্ছে বুনো হাঁস, ঘাস, হাওয়ার রাত, চালতা ফল, পেঁচা, শঙ্খমালা ইত্যাদি। উপমা ও চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন এসব উপাদান দিয়েই। জীবনানন্দের আকাশ ‘ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতো রঙের’, কখনো ‘কোমল নীল ঘাসফড়িঙের দেহের মতো’ মনে হচ্ছে।
হৈমন্তিক ও রূপসী বাংলার আনাচে-কানাচে থাকা জগৎ নিয়ে উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও অলংকার দিয়ে কাব্যশৈলীকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। আর এ বিপুল সক্ষমতা জীবনানন্দকে প্রতিনিয়ত ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দিচ্ছে। তাঁর কবিতা পড়লেই কবিতার প্রেমে পড়ে যেতে হয়েই। তাঁর কবিতার প্রকাশভঙ্গির নান্দনিকতা সব পাঠককে মুগ্ধ করবেই। শিশিরের মতো শব্দ করে, মেঠো চাঁদ কাস্তের মতো বাঁকা (পেঁচা), ঠান্ডা ফেনা ঝিনুকের মতো চুপে আমি/সেইখানে রবো প’ড়ে (কয়েকটি লাইন), ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে (অনেক আকাশ), পাখির মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে (অনেক আকাশ), এলোমেলো আঁধারের মতো, ঢেউয়ের ফেনার মতো ক্লান্ত, ঘুমন্ত বাঘের বুকে বিষের বাণের মতো বিষম সে ক্ষত, মেঘের চিলের মতো-দুরন্ত চিতার মতো বেগে ছুটে যাই, পাষাণের মতো হাত, কাচের গুঁড়ির মতো শিশিরের জল, পরী নয়,—মানুষও হয়নি এখনো, যেই কুঁজ-গণ্ডে মাংসে ফলিয়াছে/নষ্ট শসা-পচা চালকুমড়ার ছাঁচে (বোধ) ইত্যাদি উপমা ও অলংকারিক ব্যবহার কবির কবিত্ব-সক্ষমতার কথা প্রমাণিত হয়। সমাসোক্তির প্রয়োগও দারুণ।
জড়শক্তির মধ্যে প্রাণ এনে দিয়ে কী কাব্যভাষা না সৃষ্টি করেছেন। জীবন বাবুর আগে এমন সমসোক্তির প্রয়োগ বিশ্বসাহিত্য(বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যে) দেখতে পেয়েছি। মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে (মাঠের গল্প, ধূসর পাণ্ডুলিপি), বরফের মতো চাঁদ ঢালিয়াছে ফোয়ারা (পেঁচা) অন্যতম উদাহরণ।
কার্তিক ও অঘ্রান নিয়ে বাংলার হেমন্ত। কার্তিক ও অঘ্রান নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ। হেমন্ত ঋতুর বিভিন্ন অনুষঙ্গ তুলে ধরেছেন কবি। তাঁর কবিতায় হেমন্তের দারুণ একটা প্রভাব রয়েছে। ‘অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে (পেঁচা)’, ‘মাঠে-মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর-/কার্তিক কি অগ্রানের রাত্রির দুপুর/হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে (পেঁচা)’, ‘চড়-য়ের ভাঙা বাসা/... শসাফুল...মাকড়ের ছেঁড়া জাল-শুকনো মাকড়সা/লতায়-পাতায় (পঁচিশ বছর পরে)’, ‘জেগে ওঠে হৃদয় আবেগ,-/পাহাড়ের মতো ঐ মেঘ/...ছেঁড়া-ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে/তরাসে ছেলের মতো,-আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে(কার্তিক মাঠের চাঁদ)’, ‘বাঁশপাতা-মরাঘাস-আকাশের তারা!/ বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা (মাঠের গল্প)’ ইত্যাদির মতো নান্দনিক হৈমন্তিক বর্ণনা পাই তাঁর কবিতায়।
জীবনানন্দের কবিতায় পাঠক কিছু খুঁজতে থাকে। শেষ হয়েও যেন হয় না শেষ। কী কোমল, অথচ কী শক্তি তাঁর কবিতায়—‘আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে’। আকাশের বিস্তৃতি ও উদারতার কথা এক পঙ্ক্তিতেই! পথের বাতাসে, রাতের বাতাস, বাতাসের সিন্ধু, তুমি আনো প্রাণে/ সমুদের ভাষা, পাখির নীড়, বনলতা সেন ইত্যাদি কোমল ও চেতনাসঞ্চারী শব্দে মিউজিক আছে, অন্তরকে ক্লান্তি দূর করার শক্তি আছে। কবিতার জানালায় এসব শব্দ দখিন বাতাস ঢুকে যায়। হালকা কখনো গাঢ় রঙে চিত্র এঁকেছেন। তাঁর স্বর আগোগোড়ায় কোমল। উদাহরণ দিই কয়েকটা—
(১) ‘মোদের জীবনে যবে জাগে পাতাঝরা
হেমন্তের বিদায়-কুহেলি--
অরুম্ভুত আঁখি দুটি মেলি
গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান’
(পিরামিড)
(২) ‘কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই’
(শঙ্খমালা)
হেমন্ত নিয়ে কবি জীবনানন্দের আলাদা আবেগ, আলাদা চিন্তাভাবনা। তাঁর প্রিয় ঋতু হেমন্ত। হেমন্ত ঋতু ও পরিবেশ নিয়ে অনেক কবিতায় প্রসঙ্গ এসেছে। সরাসরিও হেমন্ত নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আবেগ ঢেলে দিয়েছেন। সে আবেগ বাড়াবাড়ি নয়—রূপসী বাংলার চিরন্তন রূপ। তাই, বিষণ্ণ হেমন্ত ঋতু, হলুদ পাতাদের ঝরে পড়া, জলের ধারে দাঁড়ানো ইত্যাদি প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে।
(১) ‘হেমন্ত এসেছে তবুও; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার
মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে-সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার
ছড়িয়ে পড়েছে জলে’
(অঘ্রান প্রান্তরে)
(২) ‘হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান রঙের সূর্যের শরীরে
শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে’
(বেড়াল)
(৩) ‘তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন--/নীল আকাশে খই ক্ষেতের সোনালী ফুলের মতো অজস্র তারা
...আমি যদি বনহংস হতাম
বনহংসী হতে তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।’
(আমি যদি হতাম)
‘থুতনিতে হাত দিয়ে তবুও চেয়ে দেখি,-/সব বাসি, সব বাসি,-একেবারে মেকি (পরস্পর)’ সাধারণ ভাষায় চরম প্রকাশ, ভাব প্রকাশে আমরা নতুনত্ব খুঁজে পাই। এমন সাধারণ প্রকাশে অনন্য কাব্য আমরা প্রচুর দেখি। ‘হলুদ বোঁটা শেফালির’, ‘ভ্যাট আশশ্যাওলার বন’ ইত্যাদির মতো সাধারণ ও আশপাশের শব্দ/জিনিস নিয়েই বেশির ভাগ কবিতা রচনা করেছেন জীবনানন্দ দাশ। চিত্রকল্প নির্মাণেও কবি জীবনানন্দ দাশ রূপসী বাংলার কাছে, হেমন্তের কাছে হাত পেতেছেন। সাধারণ জিনিস নিয়ে কী অপূর্ব চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন তিনি। তিনি বলতেন, চিত্রকল্পই কবিত্ব। আধুনিক কবিতা মানে চিত্রকল্প নির্মাণ।
পঞ্চেন্দ্রীয়র যত বেশি ব্যবহার করে চিত্রকল্প নির্মাণ করা যাবে, কাব্যভাষা বা কাব্যশৈলী ততই উন্নত হবে। ‘অপরাজিতার মতো নীল হয়ে- আরো নীল, কল্কা পেড়ে শাড়ি প’রে কোন এক সুন্দরীর শব (যতদিন বেঁচে আছি, রূপসী বাংলা)’ বা ‘কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো, বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে, নরম ধানের গন্ধ, কিশোরীর চাল-ধোয়া ভিজে হাত, পায়ে-দলা মুথাঘাস (আকাশে সাতটি তারা)’ ইত্যাদির মতো নান্দনিক সব চিত্রকল্প নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
লেখক: আবু আফজাল সালেহ, কবি ও উপপরিচালক (বিআরডিবি), সাতক্ষীরা