চট্টগ্রাম, যত্রতত্র শহরের বাজার নাকি বাজারের শহর

কোথাও সকাল সকাল, কোথাও–বা ছুটির দিনে, ভ্যানে সবজি বিক্রেতার ডাকেই ঘুম ভাঙে অনেকের। অনেক বিক্রেতা আবার কাস্টমারকে টোটাল সেবা দেওয়ার জন্য সবজির পাশাপাশি মাছ-মাংস-ডিম এসবও রাখা শুরু করেছেন। শুধু বিক্রিই নয়, বিল্ডিংয়ের সামনে কাটাকুটির কাজও সারেন অনেকে। বর্জ্যগুলো কোথাও কোথাও পাশে স্তূপ করে রেখে যান।

হয় কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে, নয়তো প্রতি শুক্রবার নিয়ম করে সুনির্দিষ্ট বাজারে গিয়ে জিনিসপত্র কেনার সংস্কৃতি এখন খুব একটা নেই। একটা সময় নগরীর মানুষজন শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একদম সকাল সকাল মাছ কিনতে যেতেন ফিশারিঘাটে। অনেকে সাশ্রয়ী দামে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাছ নিতেন ওখান থেকে, অনেকে ঘরের নিয়মিত রান্নার জন্য নিতেন। এখন তা–ও অনেকের করতে হয় না।

বাসা থেকে বের হতেই অলিতে গলিতে বাজার, রাস্তাঘাটে বাজার, পাড়া–মহল্লায় বাজার, ফুটপাতে বাজার, পার্কের পাশে বাজার, এখানে–ওখানে সবখানেই বাজার। যেন বাজারের শহর!

যদিও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, নগরীতে কিছু বাজার আবার এমন, সকালে মানুষজন ব্যায়াম বা প্রাতর্ভ্রমণ করতে যাবেন, ফিরতি পথে তাঁদের সুবিধার্থে বসে যায় বাজার। যেখানে সবই পাওয়া যায়, কোথাও আবার চড়া দামে। নির্ধারিত সময়ের পর কোথাও আবার বিক্রেতাদের বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে তুলে দিতে হয় জোর করেই।

সকালে সন্তানদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অভিভাবকদের সুবিধার্থে সবজি, মাছ, মাংস এসব নিয়ে বসে পড়েন বিক্রেতারা। সকালে এমন জটলা নিত্যদিনের।

আদালতকেন্দ্রিক নানান পসরা সাজিয়ে বিক্রেতাদের বেচাবিক্রি চলে দিনভর। আদালতে নানান কাজে আসা–যাওয়া করা মানুষজন যেমন এসবের ক্রেতা, আবার দিন শেষে অনেক আইনজীবী ঘরে ফেরার আগে এখান থেকে সদাই কিনে ফেরেন।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

শুধু নিউমার্কেটকেন্দ্রিক রিয়াজউদ্দিন বাজার ছাড়া সারা শহরের নির্ধারিত প্রসিদ্ধ বাজারগুলোতে শহরবাসীর যাতায়াত যে খুব একটা নেই, সেটা অনুমান করা যায়।

যেখানে–সেখানে গড়ে ওঠা বাজারগুলোতে যে শুধু ক্রেতা–বিক্রেতার স্বার্থ জড়িত, তা কিন্তু নয়। এগুলো বসতে দেওয়ায় সবচেয়ে বিপজ্জনক ভূমিকা রাখে এলাকাভিত্তিক অদৃশ্য মাফিয়াদের সঙ্গীরা।

ঘরের কাছে বেশ কিছু বছর ধরে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বাজারটিতে অবৈধ ভাসমান দোকানিদের কাছ থেকে প্রায় দিন হ্যাংলা–লিকলিকে মাদকাসক্ত টাইপের লোকটার চাঁদাবাজি দেখলে বোঝা যায়, কোনো বটগাছের ছায়া ছাড়া লোকটা এতটা বেপরোয়া হতে পারে না। তাই সব দেখে সাধারণ জনগণ কেউ আর বিপ্লবী হতে চায় না।
বন্দরনগরীর সৌন্দর্য বা ঐতিহ্যে সুনির্দিষ্ট পুরোনো বাজারগুলোও একটা অংশ, সে ঐতিহ্যও এখন বিলুপ্তির পথে।

দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, বক্সিরহাট, রিয়াজউদ্দিন বাজার, কাজীর দেউড়ি বাজার, চকবাজার, বহদ্দারহাট কাঁচা বাজার, কামাল বাজার, বিবিরহাট, ফতেয়াবাদ, চৌধুরীহাট, দেওয়ানহাট, চউক কর্ণফুলী মার্কেট, হালিশহর কাঁচা বাজার, সরাইপাড়া, সিইপিজেড মোড়, কাটগড় বাজার, পতেঙ্গা বাজার—এই নির্ধারিত হাটবাজারগুলোতে নগরীর মানুষ একটা সময় যে যাঁর কাজের ফাঁকে সুবিধাজনক সময়ে বাজার সদাই করতেন। তখন শহরও তুলনামূলক অনেক পরিচ্ছন্ন ছিল। ‘হাতের নাগালেই সব’—এমন নেতিবাচক মানসিকতার বিস্তারও খুব একটা ঘটেনি তখন। আর এখন দৃশ্যপট একেবারে পুরোটাই উল্টো।

কোনো কোনো জায়গায় বড় বড় অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসরতরা পারেন তো যাঁর যাঁর বিল্ডিংয়ের সামনেই একেকটা বাজার বসিয়ে দেন। হাতের নাগালে বাজার নাগরিক সুবিধায় যতটা না সহজলভ্যতা, তার চেয়ে বরং অনভ্যস্ততা-অলসতা, অকর্মণ্যতা, শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া ছাড়া কিছুই নয়। বছরের পর বছর যা বেড়েই চলেছে।

গত ২০ বছরে নিজের চোখে যা দেখেছি, নগরীর অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় যে উন্নয়ন হয়েছে, যেভাবে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে দ্বিগুণ, তিন গুণ; গুরুত্বপূর্ণ দুই–তিনটি পয়েন্ট ছাড়া, প্রায় প্রতিটি সড়কের সম্প্রসারিত অংশের পুরোটাই অবৈধ পার্কিং, বাজার, হকারের দখলে। এতে নেপথ্যের কুশীলবরা ফুলে–ফেঁপে বড় হচ্ছে।

অবৈধ দখল বা উচ্ছেদের নামে কিছুদিন পরপর যা দেখি, তা হাস্যকর মনে হয়। কারণ, সপ্তাহ পার হতে না হতেই সেই পুরোনো চিত্র।

নাগরিক হিসেবে আমরা নিজেরাই চরম উদাসীন। শুধু নিজের সুবিধাটাই প্রত্যাশা করি, ভূমিকা রাখার বেলায় একেবারে শূন্য। শহর পরিচ্ছন্নতায় সিটি করপোরেশন প্রতিনিয়ত সাধ্যমতো ভূমিকা রাখলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই চরম অসচেতন। শহর দিনে দিনে ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায়, মাত্রাতিরিক্ত যানবাহনে, ধুলাবালুতে দূষণের মাত্রাও বেড়ে চলেছে।দিন দিন আমি বা আমরা এতটাই ননীর পুতুল হয়ে যাচ্ছি যে বাজার তো বাজার, প্রাত্যহিক নানান সুবিধা নিতে নিতে কয়েক দিন বাদে হয়তো ঘরে ঘরে গিয়ে শৌচকর্ম ও তিন বেলা আহার করিয়ে দেওয়ার মানুষ সাপ্লাইয়ের এজেন্সি তৈরি হয়ে যাবে, নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে সেবা দিতে।

যত দিন আমরা ভাড়াটিয়া মানসিকতা থেকে বের হয়ে এই শহরকে নিজের শহর হিসেবে ভাবতে না পারব, তত দিন হয়তো ক্রমেই অধগতির এই সিস্টেম থেকে মুক্তি মিলবে না। আর মনের খোরাকের জন্য দেশের পরিচ্ছন্ন শহরের রোল মডেল রাজশাহী গিয়ে ঘুরব, ছবি তুলব, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাব্যিক ভাষার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আফসোসের ঢেকুর তুলব।

লেখক: অজয় মিত্র, সংস্কৃতিকর্মী ও আয়কর আইনজীবী