বাঘবিধবাদের জনপদে একদিন

সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনছবি: সংগৃহীত

এখন খাদিজা বেগমের বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। তবে এক ঝলক ভালো করে তাঁর দিকে তাকালেই তারুণ্যের দিনগুলোয় কতটা আকর্ষণীয় ছিলেন সেটা যে কেউ বুঝতে পারবেন। তাঁর পলিত ত্বকের হরিদ্রাভা এখনো যে কাউকে মুগ্ধ করার মতো। অথচ এই বৃদ্ধার গোটা তারুণ্য ও প্রৌঢ়ত্ব কেটেছে নিঃসঙ্গতায়। কারণ, তিনি একজন ‘বাঘবিধবা’।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বিঘা ধূমঘাট গ্রামে হালিমা বেগমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আমার বর্তমান কর্মক্ষেত্র বিফরআরএল-সিএনআরএসের হয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর অঞ্চলে জেন্ডার বা লৈঙ্গিক অবস্থান কর্মসূচির অবস্থান বুঝতে একটি এফজিডি করার সময় এই বাঘবিধবার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পাশে ছিলেন তাঁর কন্যা, মধ্য-ষাটের হালিমা বেগম।

‘আমার বাড়িওয়ালার (শ্যামনগর অঞ্চলে স্বামীকে ‘বাড়িওয়ালা’ বলা হয়) নাম ছেলো ওয়াজেদ সরদার। তিনি নৌকাতি করি বাদায় গেছিলেন—ওই তোমার মহাজনি নৌকায় করি কাঠ কাটতি গেছিলেন। সেখানেই বাঘ তাঁর ওপর হঠাৎ ঝাঁপায়ে পড়িছিল। তখন আমার প্রথম মাইয়ার বয়স মাত্র ৯ মাস। ওই একটিই সন্তান,’ খাদিজা বেগম চোখের পানি মোছেন।

পরে আর বিয়ে করেছেন কি না, জিজ্ঞাসা করায় এত বয়সেও অশ্রুসজল চোখে বললেন, ‘না, আমারে উনি খুব ভালোবাসতেন বলি আর বিয়ি করিনি।’

বাঘবিধবা খাদিজা বেগম
ছবি: সংগৃহীত

একমাত্র কন্যাশিশুকে নিয়ে বাবার ঘরে ফেরার পর চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া খাদিজা বেগম অনেক প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুকে পড়ানোর কাজ করেছেন। বাবার বাড়িতেও মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ছিল। আজ তাঁর সেই এক মেয়ের ঘরেই অনেক নাতি-নাতনি। ‘বাঘবিধবা’ হিসেবে কোনো ভাতা পেয়েছেন কি না, জিজ্ঞাসা করলে তাঁর মেয়ে হালিমা বেগম বলেন, বন বিভাগ থেকে নতুন এক আইনে ২০১৫ সালের পর থেকে বাঘের আক্রমণে গুরুতর আহত এবং অসুস্থ, কর্মক্ষম হয়ে যাওয়া কারও পরিবার ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং বাঘের আক্রমণে নিহত হলে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। তবে এই আইন ২০১৫ সালের আগে বাঘে নিহত-আহত ব্যক্তিদের পরিবারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

‘আমার বাড়িওয়ালা মারা যান বহু বছর আগে—আমার বয়স তখন উনিশ-কুড়ির বেশি না,’ বলেন খাদিজা বেগম।

‘আমার বাড়িওয়ালা যখন বনে যেতেন, তখন আমার শাশুড়ি আমাগের উপদেশ দিতেন যেন রান্না করার সময় বেশি ধোঁয়া না বানাই। তখন বিশ্বাস ছিল কি যে আমার রান্নায় যদি বেশি ধোঁয়া হয়, তালি সেই ধোঁয়ায় বনের মইদ্যি আমার বাড়িওয়ালা পথ হারায়ি ফেলবেন। এখন এসব আর লোকে অত মানে না—বনে বাঘের হামলাও কম,’ বলেন হালিমা বেগম।

আবার শ্যামনগরের মালঞ্চ নদীতীরবর্তী মথুরাপুর গ্রামের আলোমতী মণ্ডলের বর বাঘের আক্রমণে মারা যান ২০১০ সালে।

‘আমার বাড়িওয়ালা সাতজন কাঠুরিয়ার সঙ্গে একটি নৌকায় করে কাঠ কাটতে গিছিল। বাসা থিকি বার হলেন সকাল সাতটায় আর রাত নয়টায় বাঘের আক্রমণে মরলেন—যখন তার কিনা দলের সবার সঙ্গে বাড়ি ফেরার কথা,’ বাঘবিধবা আলোমতী মণ্ডল বললেন।

‘তা আমাগের কাছি খবর আলি পর আমরা সবাই গেলাম সেখানে। বাঘ কিন্তু পুরুষ মানুষির পেটটা আগে খায়। তা আমি আমার বাড়িওয়ালার লাশ পেয়িছি ঠিকই, পুরো শরীরটা পাইনি। আমার ছেলি আর মেইয়ি দুটোই তখন ছোট।’

সেই শুরু হয়েছিল আলোমতীর জীবনসংগ্রাম। কখনো কৃষিখেতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে আর কখনো নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তাঁর কন্যা বর্তমানে বিবাহিত এবং এখন শ্যামনগরে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন।

‘আমার ছেইলিটা ইটভাটায় কাজ করে। ওর বউ আছে আর আমার একটা নাতনিও আছে। তয় জিনিসপত্রের যা দাম, তাই আমিও কাজ করি। মাছ ধরি, বনে যাই। কাজ তো করতি হয়, বোঝেন না?’ আলোমতী বলেন।

২০১০ সালে আলোমতীর জীবনসঙ্গী মারা গেছেন বলে আলোমতী ২০১৫ সালে বন বিভাগের প্রণীত নতুন আইন অনুযায়ী এক লাখ টাকা পাওয়ার দাবিদার নন। যেহেতু এই আইনটি ২০১৫ সালের পর থেকে বাঘের আক্রমণে নিহত-আহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি প্রযোজ্য হবে।

মথুরাপুর গ্রামেরই আরেক বাঘবিধবা ফিরোজা তাঁর জীবনসঙ্গীর মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে গিয়ে বললেন, ‘সেটা ছেলো ২০০১ সালের ১০ রমজানের দিন। দুপুর একটার দিকে আমার বাড়িওয়ালা বাদাতে গেইছিল আর বিকেল পাঁচটাতেই বাঘের হামলায় মারা পড়ল। খবর যখন আসলো—আমার দুই দেওর ছেলো টাইগার কমিটিতে, মানে ওই যে কমিটির কাজ হলো বাদায় কেউ মারা পড়লি সেই লাশ খুঁজে বাড়ি আনা আর বাঘ যদি বাদা ছাড়ি গেরামের দিকি আসা শুরু করে, মানুষজনরি খবর দেওয়া। আমার দুই দেবর বনে দেলো দৌড়। সঙ্গে তল্লাটের ২০০–৩০০ মানুষ। বাঘ তার গলা টিপি ধরছেল কিন্তুÍতার শরীর পুরো ঠিক ছেলো।’

বাঘবিধবা আলোমতী মণ্ডল
ছবি: সংগৃহীত

‘আমার শাশুড়ি তখন কুটুমবাড়ি ছেলেন। তানার ফিরতি দেরি হচ্ছিল বলে সোমবার রাতে আমার বাড়িওয়ালার বডি পাইছিলাম আর বুধবার রাতে এশার নামাজের পর তাঁর কবর হয়। আমার দুই বাচ্চাই তখনো কোলে,’ ফিরোজা বেগম জানান।

বাবার বাড়িতে ফিরে এসে, দুই সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য ফিরোজা বিভিন্ন বাড়িতে বাবুর্চির কাজ নেন।

‘একে তখন আমার বয়স কম আর তাতে গেরামের মানুষ একা বিধবাকে দেখলে উত্ত্যক্ত তো করতই। তখনকার দিনে গ্রামে বিয়েশাদিতে লোকের বাড়িতেই রান্না হতো। আমি ওই বাবুর্চির রান্না করলি পর একটু ভালো খাবার আমার দুই বাচ্চার জন্য আনতি পারতাম। বাকি সময় ঘরের বার হতাম না। কিন্তু বাপ-মা মরার পর থাকপ কোথায়? তখন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আর মেম্বার ‘কারিতাস’ এনজিওকে বলল আমাকে একটা কুঁড়েঘর তুলি দিতি, যাতে আমি আমার দুই বাচ্চারে নিয়ি একটু মাথা গুঁজতি পারি,’ ফিরোজা জানান।

ফিরোজার মেয়ে বর্তমানে বিবাহিত এবং বর্তমানে তাঁর একটি নাতিও রয়েছে।

‘আমার ছেলিও বিয়ি করছে—ও ভ্যান চালায়। কিন্তু কয়েক কেজি চালেরই এখন কত দাম! তাই আমি এখনো জনমজুরির কাজ করি আর মাছও ধরি। তইলি এখন যাই? মালঞ্চ নদীতি এখন জোয়ার আসপে আর আমি ঘণ্টা দুই জাল নিয়ি নদীর পাড়েতে বসি থাকপ,’ ফিরোজা বললেন।

তখন ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা ছয়টা ছুঁই ছুঁই করছিল।

না, ফিরোজাও নতুন বন আইনের আওতায় বাঘবিধবা হিসেবে কোনো সুরক্ষা বা ক্ষতিপূরণের অর্থ পাননি।

বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ‘ব্র্যাক আশ্রয়ণ পাড়া’ গ্রামের আমোদিনী নিজে বাঘবিধবা না হলেও তাঁর বাবা বাবু রাম সরদার প্রায় ২০ বছর আগে বাঘের আক্রমণে মারা গিয়েছিলেন।

‘আমার তখন বিয়ি হইয়ি গেছিল আর দুইটা বাচ্চাও হয়িছে। কিন্তু অন্য ভাইবোনেরা তখনো ছোট ছোট। এ সময়ই মাথার ওপর বাজ পড়ল। এক সন্ধ্যায় বাবা সুন্দরবনে মহাজনি নৌকায় চড়ি গেছিল, আর সেই সন্ধ্যাতেই বনের ভিতর কাঠ কুড়াতি গিয়ি বাবা মইরে গেল। তখন আমি আমার ছোট ভাইবোনদেরও দেখা শুরু করলাম,’ আমোদিনী স্মরণ করেন।

‘আমরা তো আইলার পর থিকি এই গ্রামে আছি। আমার মা-ও এখন আমাগের সঙ্গে থাকে। তয় তার বয়স আশির ওপর, হাঁটতি-চলতি তত পারে না,’ আমোদিনী আমাদের বলেন।

না, আমোদিনীর মা-ও বাঘবিধবা হিসেবে কোনো ভাতা পাননি।

‘ব্র্যাক আশ্রয়ণ পাড়া’ গ্রামেরই শেফালী রানী, যাঁর জীবনসঙ্গী মারা না গেলেও ভাশুর আজ থেকে ২০ বছর আগে মহাজনি নৌকায় চেপে বনে কাঠ কাটতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মারা যান, তাঁর বিধবা বড় জা দীর্ঘ দুই দশক দুই সন্তানকে নানা কষ্টে মানুষ করে, খুব সম্প্রতি সবাইকে অবাক করে দিয়ে পুনর্বিবাহ করেছেন বলে জানান।

বাঘবিধবা ফিরোজা বেগম
ছবি: সংগৃহীত

শেফালী রানী তাঁর অবাক করে দেওয়া একটি পর্যবেক্ষণ থেকে আমাদের বলেন, ‘আজকাল মানুষ মহাজনের বদলি এনজিওদের কাছ থিকি লোন নেয় বলে আগে যেমন মহাজনি নৌকায় চড়ে বনে অনেকটা সময়ের জন্য মাছ ধরতি বা কাঠ কাটতি গিয়ে অনেক মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা যেত, এখন তার হার কমিছে। এখন আমাদের নিরাপত্তা বাড়িছে।’

বন বিভাগের এক জরিপে দেখা যায়, ২০১১-১২ থেকে ২০১৯-২০ নাগাদ বাঘের আক্রমণে মোট ৪৬ জন মানুষ নিহত এবং ১৬ জন আহত হয়েছেন (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২১ মার্চ-২০২১)।

‘বাংলাদেশে ২০১৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত বন আইনের আওতায় বাঘবিধবা বা বাঘের হামলায় নিহত-আহত বনজীবীদের পরিবারের আর্থিক সুরক্ষার জন্য কোনো আইন ছিল না। নতুন বন আইন প্রণীত হলেও একে তো বাঘের আক্রমণে অতীতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবার সেই আইনের আওতায় কোনো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না, তাতে এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলে পত্র-পত্রিকায় কিছু প্রতিবেদন দেখা যাচ্ছে। এদের ক্ষতিপূরণের জন্য প্রণীত আইনটি তাই যথার্থভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত,’ বলেন ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অসংখ্য জেলায় কর্মরত জাতীয় পর্যায়ের পরিবেশবাদী উন্নয়ন সংগঠন সিএনআরএসের নির্বাহী পরিচালক ড. মোখলেছুর রহমান।

‘পরিবেশ-নারীবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে নারী ও পরিবেশ বা প্রতিবেশব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সম্পর্ককে মূল্যায়ন করা এবং প্রতিবেশব্যবস্থার ব্যবস্থাপনায় জেন্ডার বিশ্লেষণ থেকে লব্ধ ফলাফল ব্যবহার করা সিএনআরএস তার জন্মলগ্ন থেকেই করে এসেছে। সুন্দরবনের মুন্ডা নারী, ঘূর্ণিঝড় আইলাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে অভ্যন্তরীণ জলবায়ু শরণার্থী, বাঘবিধবাসহ সবাই সিএনআরএসের এই নির্দিষ্ট প্রকল্পের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত,’ বলেন সিএনআরএসের পরিচালক আনিসুল ইসলাম।

‘সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, খুলনার দাকোপ ও কয়রা এবং মাগুরা ও নড়াইলের তিনটি পরিবেশগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মধ্যে কর্মরত, যার মধ্যে বাঘবিধবা, বনজীবী নারী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীসহ অনেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রয়েছে। সুন্দরবনসংলগ্ন বাংলাদেশের এই বিশেষ এলাকার নারীদের জীবন-জীবিকার সংগ্রামের নানা দিক, পরিবেশ ও ভৌগোলিক প্রতিকূলতার দিকগুলো বিশ্লেষণ করা আমাদের লক্ষ্য,’ বলেন সিএনআরএস-বিফরআরএল প্রকল্পের পরিচালক মাহবুবুর রহমান।

*লেখক: অদিতি ফাল্গুনী, যোগাযোগ ব্যবস্থাপক, বিফরআরএল-সিএনআরএস
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]