ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা রোধে সাবধানতা ও সবার সহায়তা কাম্য
আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন লোকজন। এক হিসাব মতে, এবারের ঈদে প্রায় এক কোটি মানুষ রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করবেন। দেশের অন্য শহর থেকেও লোক যাতায়াত করবেন। মোট যাত্রীর ৭৩ শতাংশ সড়কপথে, ১৭ শতাংশ নৌপথে এবং ৮ শতাংশ রেলপথে যাতায়াত করবেন। ঈদযাত্রায় রেলপথ তুলনামূলক ব্যয়সাশ্রয়ী ও নিরাপদ। রেলযাত্রায় মানুষের আগ্রহ অনেক বেশি। ঈদযাত্রায় যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনা করে সর্বোচ্চসংখ্যক যাত্রী পরিবহনের জন্য রেল কর্তৃপক্ষও যথারীতি সচেষ্ট। এ জন্য ২৪ মার্চ হতে আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন অতিরিক্ত পাঁচ জোড়া ট্রেন পরিচালনা করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ সময় নিয়মিত চলাচলকারী আন্তনগর সব ট্রেনের সাপ্তাহিক বিরতি বাতিল করা হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত যাত্রী চাহিদা পূরণের জন্য ২৮টি মিটারগেজ, ১৬টি ব্রডগেজ কোচসহ মোট ৪৪টি কোচ বিভিন্ন যাত্রীবাহী সার্ভিসে যুক্ত করা হয়েছে। এতৎসত্ত্বেও রাজধানী ঢাকা থেকে প্রতিদিন মাত্র ৩৫ হাজারের কিছু বেশি যাত্রী পরিবহন করতে পারবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। নৌপথ নিরাপদ হলেও এর যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা খুব সীমিত। ঈদযাত্রায় মোট যাত্রীর সিংহভাগই সড়কপথে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করবেন।
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও সড়কপথে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে যাত্রী পরিবহনের জন্য সরকারের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাড়তি ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ভাঙাচোরা রাস্তা ইতিমধ্যে যথাসম্ভব মেরামতের চেষ্টা করা হয়েছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা দ্বারা সার্ভিলেন্সের আওতায় আনা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন স্থানে সাইন সিগন্যালগুলো যথাযথভাবে কার্যকর করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সম্ভাব্য যানজট এড়াতে টোল প্লাজাগুলোর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, লেভেল ক্রসিং ও রোড ক্রসিংয়ে নেওয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা। এসব সতর্কতা প্রতিবছরই গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, যানজট, যাত্রী ভোগান্তি, যাত্রী হয়রানি প্রতিবছরই আগের বছরের তুলনায় বাড়তে থাকে। এই প্রবণতা রোধ করা জরুরি ও আমাদের অবশ্য কর্তব্য। যাত্রীদের নিরাপদ, নির্বিঘ্ন ও হয়রানিমুক্ত ঈদযাত্রা নিশ্চিত করা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মূল দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে কেউ অবহেলা বা গাফিলতি প্রদর্শন করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি হলেও দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত একেবারেই নগণ্য।
ঈদযাত্রা শুরু হলে সড়কে ফিটনেসবিহীন লক্করঝক্কর বাস, এমনকি দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহনেও নেমে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এসব বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। তাই ঈদযাত্রায় অন্তত ১৫ থেকে ২০ দিন আগে থেকেই সড়কে ফিটনেসবিহীন ও রুট পারমিটবিহীন গাড়ি চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয়েছে। ঈদযাত্রায় অধিকসংখ্যক বাস অধিক ট্রিপ পরিচালনা করায় চালক ও সাপোর্টিং স্টাফদের অতিরিক্ত খাটুনি খাটতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে একজন চালক টানা দুই বা তিন দিন ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন, মাঝে পর্যাপ্ত বিশ্রামের সময় পাচ্ছেন না। এতে তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবসাদ কাজের প্রতি অমনোযোগিতা সৃষ্টি করে। এতে সাপোর্টিং স্টাফদের দ্বারা তেমন ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলেও চালকদের অমনোযোগিতার কারণে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই প্রতিটি দূরপাল্লার বাসে একজন বিকল্প চালক রাখা এবং চালকদের প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতির কার্যকর ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে।
ঈদযাত্রায় যাত্রী চাহিদা অধিক হওয়ায় পরিবহন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অন্যতম লক্ষ্য থাকে যে একই গাড়ি দিয়ে অধিকসংখ্যক ট্রিপ পরিচালনা করে অধিক পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা। এ জন্য চালকদের ওপর গাড়ি জোরে চালানোর জন্য একটা বাড়তি চাপ থাকে। তা ছাড়া সাধারণত চালকদের নিয়মিত বা মাসিক ভিত্তিতে বেতন–ভাতা না দিয়ে মালিকপক্ষ ট্রিপভিত্তিক মজুরি দেয়। ফলে চালকেরা বাড়তি রোজগারের আশায় বাড়তি ট্রিপের পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালান। এ ধরনের মনোভাব পরিহার করে যাত্রীদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া এবং অধিক মুনাফার লোভে যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওভার স্পিডে গাড়ি চালানো বা চালাতে বাধ্য করা পরিহার করতে হবে। চালকদের ট্রিপভিত্তিক মজুরি না দিয়ে নিয়মিত বা মাসিক বেতন-ভাতার ভিত্তিতে নিয়োগের সংস্কৃতি চালু করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আইন প্রয়োগে আরও কঠোর হতে হবে। অনুমোদিত গতিসীমা অতিক্রম করলে সংশ্লিষ্ট চালক ও মালিকপক্ষকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতিবছর ঈদযাত্রার প্রাক্কালে রাস্তার মেরামতের কাজ শুরু করা হয়। এ সময় একদিকে রাস্তায় যানবাহনের চাপ থাকে বেশি, অন্যদিকে মেরামতের কাজের জন্য রাস্তায় যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যা তীব্র যানজট সৃষ্টি করে। এ জন্য রাস্তার প্রয়োজনীয় মেরামত ও সংস্কারকাজ ঈদযাত্রা আরম্ভ হওয়ার আগেই শেষ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও কর্তৃপক্ষকে আরও আন্তরিক ও সতর্ক হওয়া উচিত।
ঈদযাত্রায় চালক, মালিকপক্ষ ও সরকার যথাযথ তৎপর থাকা সত্ত্বেও যাত্রী সাধারণ সচেতন না হলে যানজট ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা কারও একার পক্ষে সম্ভব হবে না। এ জন্য যাত্রীদেরও সচেতন, সহনশীল ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যেহেতু এবার অফিস আদালতে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার আগেই স্কুল–কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি দেওয়া হয়েছে। তাই সম্ভব হলে ছেলেমেয়ে, শিশুসহ কর্মজীবী সদস্য বাদে পরিবারের অন্যদের ঈদযাত্রা শুরু হওয়ার আগেই গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। কর্মজীবী সদস্যরা পরে ধীরেসুস্থে যাত্রা করলে ভোগান্তির মাত্রা কমে আসবে অনেকাংশে।
রাস্তায় সম্ভাব্য যানজটের কথা মাথায় রেখে সে মোতাবেক প্রস্তুতি রাখতে হবে। সামান্য কিছু শুকনা খাবার ও পানি সঙ্গে রাখা ভালো। রাস্তায় বা যানবাহনে অপরিচিত কারও দেওয়া বা অপরিচিত কারও কাছ থেকে কিছু কিনে খাওয়া উচিত নয়। এতে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। যাত্রার প্রাক্কালে মুঠোফোনে পর্যাপ্ত ব্যালান্স ও চার্জ রাখতে হবে যেন রাস্তায় যেকোনো বিপদাপদ হলে আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতজনদের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করা যায়। জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখা ভালো। খুব বেশি পরিমাণ নগদ টাকা বা ব্যাংকের ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড নিয়ে ভ্রমণে বের না হওয়াই ভালো। অনেক ক্ষেত্রে ছিনতাইকারী চক্র অপহরণের মাধ্যমে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন করতে পারে। সর্বোপরি চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে কথা বলা বা গাড়ি দ্রুত চালানোর জন্য তাঁকে চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়। মনে রাখবেন, ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত খাটুনির জন্য তাঁরা ইতিমধ্যেই অবসাদগ্রস্ত, তাঁকে স্বস্তিতে ঠান্ডা মাথায় গাড়ি চালাতে দিন। এসব বিষয় আমরা সবাই কমবেশি জানি, কিন্তু বাস্তবে মনে রাখার বা সে অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করার চেষ্টা করি না। আমাদের মনে রাখা উচিত, এসব ছোটখাটো সতর্কতা আমাদের বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। নিজে সচেতন থাকুন, অন্যের বিরক্তির কারণ হবেন না। নিরাপদ, নির্বিঘ্ন ও হয়রানিমুক্ত ঈদযাত্রা সবার কাম্য।
লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, রেলপথ মন্ত্রণালয়
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]