আফগানিস্তানে মার্কিন-ন্যাটোর জেনারেলদের চরম ব্যর্থতা ও পতনের কারণগুলো

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী সরে যাওয়ার পর ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট চূড়ান্তভাবে তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল সম্পূর্ণভাবে দখল করে নেয়। তালেবান কাবুলসহ গোটা দেশ পুনর্দখল করায় আমি মোটেই বিস্মিত বা হতবাক হইনি। বরং গোটা দেশের শক্তিশালী বিমানঘাঁটি, ক্যান্টনমেন্ট, গোয়েন্দা পুলিশ সদর দপ্তর, প্রাদেশিক গভর্নর অফিস ভবনসহ সব জেলা (৪১২ জেলা) একের পর এক আফগান বাহিনীর অবস্থান থেকে তালেবানদের দখলে চলে যাওয়ার ঘটনায় আমি শুধু হতবাক ও বিস্মিত হয়েছিলাম।

কাবুলের পতন হওয়ার পর আমি আশান্বিত ছিলাম, হয়তো বা অন্ততপক্ষে কাবুল রক্ষার্থে আফগান সরকারপ্রধান আশরাফ গনি আফগান সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের সম্মিলিত একটি অভেদ্য মজবুত প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। পাশাপাশি আফগান বিমানবাহিনী কাবুলের দিকে অগ্রসরমাণ তালেবান বাহিনীর ওপর মুহুর্মুহু গোলা ছুড়ে তাদের অগ্রযাত্রার অবস্থানকে ধ্বংস করে দেবে। কাবুলের জনগণও রাজধানীর রাস্তায় বিশালাকার সমাবেশ করে আফগান সরকার ও তালেবানবিরোধী অভিযানে আফগান সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে সমর্থন জানিয়ে সভা সমাবেশ করবে।

১৫ আগস্ট ২০২১ তালেবান বাহিনী কর্তৃক গোটা আফগানিস্তান সম্পূর্ণভাবে করায়ত্ত হওয়ার বিভিন্ন সংবাদচিত্র নজরে আসায় প্রথমে আমি একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলাম। ভেবেছিলাম, বৈশ্বিক মহামারি করোনার ছোবলে মিডিয়া টেলিভিশনে ধারণকৃত ও প্রেরিত সংবাদমাধ্যমগুলোও কি তাহলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে রংবেরঙের সচিত্র প্রতিবেদন প্রেরণ করছে? আমি একটু ধৈর্য, সহিষ্ণুতাসহ ১৫ আগস্ট কাবুল দখলে উল্লসিত তালেবান বাহিনীর সদস্যদের অভিযানের প্রতিটি মুহূর্ত, ছবি, সংবাদ মনোযোগসহ গভীরভাবে বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গি নিয়ে অবলোকন করার চেষ্টা করছিলাম।

প্রথমত, দলের মধ্যে অল্পবয়স্ক ১৮-৩০ বছরের তালেবানদের চোখে রয়েছে প্রখ্যাত ইতালিয়ান গুচি ও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি উইলি এক্স ডব্লিও এক্স সানগ্লাস, যা সাধারণত মার্কিন ও বহুজাতিক বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করে থাকেন। এই গ্রুপের সদস্যদের হাতে দেখা যায় সর্বাধিক অ্যাপেল, স্যামসাং মডেলের মুঠোফোন; তাঁদের অধিকাংশের মাথায় দেখা যায় পাকিস্তানের তৈরি রংবেরঙের পাথরখচিত সিন্ধি টুপি, যা আমাদের দেশে এখনো ঢাকায় অবস্থারত মিরপুর-মোহাম্মদপুরের পাকিস্তানি বিহারি উদ্বাস্তু নাগরিকেরা এবং পাকিস্তানপ্রেমীসহ পাকিস্তানের করাচিতে লোকেরা এখনো প্রিয় পবিত্র টুপি হিসেবে মস্তক আচ্ছাদনে ব্যবহার করে থাকেন।

দ্বিতীয়ত, অপর গ্রুপটির ৪০-৫০ বছর বয়সী অধিকাংশ ব্যক্তির মাথায় কালো পাগড়ি, গায়ে লম্বা পাঞ্জাবি, পায়ে চপ্পল অথবা এক জোড়া পাকিস্তানি স্বল্প মূল্যের পেশোয়ারি চপ্পল অথবা একটু দামি কোলহাপুরি হিপ্পি চপ্পল। আবার অনেক উচ্ছ্বসিত-আনন্দিত তালেবান সদস্যের পায়েই দেখা গেছে আত্মসমর্পণ করা আফগান সেনা ও পুলিশদের কাছ থেকে ছিনতাই করা সামরিক বুট জুতা পরিহিত অবস্থায় কাবুলের সড়ক–মহাসড়কে বিভিন্ন মডেলের সামরিক ও পুলিশের গাড়িতে টহল দিতে। তবে গুচি ও উইলি এক্সডব্লিউএক্স সানগ্লাসও পাকিস্তানের সিন্ধি টুপি পরিহিত যুবক তালেবানদের দেখে আমার মনে হয়েছিল, তাঁরা হয়তো পাকিস্তানের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের আফগান সীমান্তের পাকিস্তানের মাদ্রাসার অর্ধশিক্ষিত অঞ্চলের আইএস পরিচালিত জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তেহেরি-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সশস্ত্র জঙ্গি যোদ্ধা। অপর বয়স্ক জঙ্গি যোদ্ধাদের চালচলন ও বেশভূষা দেখে মনে হয়, তাঁরা আফগান অথবা টিটিপি, আফগান যৌথ তালেবান বাহিনীর নিয়মিত সদস্য অথবা কট্টর পাকিস্তানপন্থী জিহাদ গ্রুপের সদস্য। আমার এ ধারণার পেছনে কারণ ছিল, আফগানিস্তানের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তবর্তী প্রদেশ জালালাবাদের তোরকাম সীমান্ত, যার পূর্ব প্রান্তে রয়েছে আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে যাওয়া–আসার পথ। তার ঠিক দক্ষিণে আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশের রাজধানী গার্দেজ (যেখানে আমি জাতিসংঘের আঞ্চলিক দপ্তরে কর্মরত ছিলাম)। পাকতিয়া ও খোস্ত প্রদেশের পূর্ব প্রান্তে অতিসন্নিকটেই পাকিস্তানের সীমান্ত। আরও একটু দক্ষিণ–পশ্চিমের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রদেশ কান্দাহার থেকে সীমান্তচৌকি ‘স্পিন বুলডাক’ পাকিস্তানের চামান হয়ে কোয়েটা শহরে যাওয়া এবং আফগানিস্তানে অবাধে প্রবেশের সড়কপথ রয়েছে। ২০২১ সালের ৬ আগস্ট প্রথম আফগানিস্তানের দক্ষিণ অঞ্চলের প্রদেশ নিমরোজের রাজধানী জারাং তালেবানদের দখলে চলে যায়। পরপর শক্তিশালী কাবুল সরকারের সামরিক ঘাঁটি কান্দাহার মাজার-ই-শরিফ ও হেরাতের দ্রুত মহামারি আকারে পতনের পর এসব প্রদেশে আত্মসমর্পণ করা আফগান সেনা, বিশেষ স্পেশাল ফোর্সেস ও পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে সংগৃহীত শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্রসহ পাকিস্তান তালেবান, হরকাতুল জিহাদের সমন্বয়ে তালেবান রাজধানী কাবুল দখলের জন্য অগ্রসর হতে থাকে এবং চূড়ান্তভাবে ১৫ আগস্ট কাবুল দখল করে নেয়। ফলে আফগানিস্তানে আবার ২০০১ সাল–পূর্ববর্তী তালেবান ও আল–কায়েদার বাধা–বিপত্তিহীন নৃশংস, মানবতাবিরোধী সব অপরাধ কার্যক্রমের নবযাত্রা শুরু হয়।

তালেবান-আল–কায়েদাবিরোধী অভিযানে মার্কিন-ন্যাটোর জেনারেলদের ব্যর্থতা ও তালেবানদের কাবুল দখলের কারণ অনেক।

রণকৌশল: ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ইঙ্গ-মার্কিন-ন্যাটোর যৌথ আন্তর্জাতিক বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে তালেবান ও আলে–কায়েদার সব কার্যক্রম নেটওয়ার্কবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আশ্রয় গ্রহণ করে পুনরায় পুনর্গঠিত হওয়ার ব্যাপক ও বিশাল রণকৌশল প্রণয়ন করে আফগানিস্তানে উপস্থিত হাজারো আন্তর্জাতিক বাহিনী এবং আফগান সেনা ও পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে নব উদ্যম ও জিহাদির জোশে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিদেশি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা শুরু করে। এ আক্রমণ শুধু সামরিক অস্ত্র, গোলাবারুদ বা বিস্ফোরক ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তালেবান বাহিনী যেসব সুদূরপ্রসারী সমন্বিত রণকৌশল বা পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে যায়, সেগুলোর বর্ণনা করা হলো—
ক) দক্ষিণ আফগানিস্তানের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে তালেবান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

পাকিস্তানের ভূমিতে তাদের সব অপকর্মের স্থায়ী ঘাঁটি ও আস্তানা থাকায় তারা দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তানসহ উত্তরে তাদের নতুন অগ্রভাগ চালু করে। তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসের রাজত্ব শেষ হলে পরে বারাক ওবামার সরকার তালেবানদের পরাজয় ও নিয়ন্ত্রণ করার নতুন নতুন রণনীতি ও কৌশল অবলম্বন করেছিল। কিন্তু নতুন নতুন পদক্ষেপ ও মার্কিন-ন্যাটোর চার তারকা জেনারেলদের রণকৌশলের অসংগতি থাকায় তালেবানদের অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য কোনো সাড়া বা জবাব পাওয়া যায়নি দেশটির বিভিন্ন এলাকার সশস্ত্র তালেবানদের বিরুদ্ধে। যদিও কিছু পদক্ষেপ ছিল ফলপ্রসূ, অপর পদক্ষেপগুলো ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক, যা তালেবানদের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করার সহায়ক শক্তিতে পরিণত করে। ২০০৯ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ২১ হাজার বহুজাতিক বাহিনীর সমাবেশ করেও তালেবানদের প্রতিহত করতে বা নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি কিংবা তাদের পূর্ব ও দক্ষিণের শক্ত–মজবুত ঘাঁটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয় তিন/চার তারকা জেনারেলরা। যেহেতু পাকিস্তান–আফগান সীমান্ত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা সম্ভব ছিল না, তাই অবাধে তালেবান বাহিনী ক্রমাগতভাবে অধিক শক্তি, অস্ত্রশস্ত্র, জনবল নিয়োগ করে বহু জাতীয় বাহিনী ও আফগান সেনা-পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলাকে আরও জোরদার করে, চার তারকা মার্কিন-ন্যাটোর জেনারেলদের ঘুম হারাম করে দেয়।

খ) তালেবানদের সম্পর্কে বহুজাতিক বাহিনী ও পাশ্চাত্যের ভুল ধারণা পোষণ ও অবমূল্যায়নকরণ: বহুজাতিক মার্কিন বাহিনীর একটি কার্যকর ও ফলদায়ক সঠিক রণকৌশলের অভাব থাকার একটি মূল কারণ ছিল, পাশ্চাত্য ও বহুজাতিক বাহিনীর তারকা জেনারেলরা তালেবানদের দক্ষতা, ক্ষিপ্রতা, রণকৌশল ও এর অভ্যন্তরে বহুজাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও হামলা করা ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণের ব্যর্থতা। তালেবানদের সম্পর্কে ন্যাটো–পশ্চিমাদের ধারণা ছিল, তালেবান অর্থ প্রতিক্রিয়াশীল, মধ্যযুগীয় দক্ষতা ও রণকৌশলে অভ্যস্ত এবং পশ্চাৎপদ একটি জঙ্গিগোষ্ঠী বা বাহিনী। তালেবানদের বিদ্রোহকে মনে করা বা উপলব্ধি করা হয়েছিল একটি স্থানীয় সমস্যা হিসেবে, যা হয়তো স্থানীয়ভাবে সমাধানযোগ্য ছিল। অপর দিকে তালেবানদের জঙ্গি তৎপরতার গতিশীলতার পরিসরকে জাতীয়ভাবে গণ্য করেননি তারকাখচিত জেনারেলরা। প্রকৃতপক্ষে তালেবান ও সশস্ত্র জঙ্গি বাহিনী কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নে ও সমন্বিতভাবে যেকোনো আক্রমণ, চোরাগোপ্তা হামলায় যথেষ্ট সমর্থ ও দক্ষ ছিল। এই জঙ্গিগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক বহুজাতীয় বাহিনীর জেনারেলদের পরিচালিত যেকোনো অভিযান ও আক্রমণকে প্রতিহত বা প্রতিরোধে সক্ষম ছিল।
তালেবান তাদের একটি কর্মকৌশল ও সুসংগত নীতি অনুসরণ করে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়েছে ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত। তালেবানদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জঙ্গি কর্মপন্থা বা কৌশল বিদেশি সমর পর্যবেক্ষকদেরও এক মহাবিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। কারণ, তালেবান গোষ্ঠী শুধু এককভাবেই আন্তর্জাতিক বহুজাতীয় বাহিনীর ও আফগান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেনি। তালেবানদের একাধিক কমান্ডার বা নেতা ছিলেন, যাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যুদ্ধ ও আক্রমণে পারদর্শী বা তারকা মানের জঙ্গি কার্যক্রমের ওস্তাদ, যদিও তাঁদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান ছিল, কিন্তু এটা কোনো বিভাজ্য বিষয় ছিল না। তালেবানের জঙ্গি সংগঠনটির কার্যপ্রণালি ছিল স্থিতিস্থাপক অবস্থায় কেন্দ্রীভূত, যথেষ্ট উপযুক্ত ও পারদর্শী। তালেবানদের নিকট স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনকে পদায়নেই ছিল তাহাদের গেরিলা কার্যক্রমকে প্রাধান্য প্রদানের মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধিকরণের। তালেবান গোষ্ঠীর যেকোনো ধরনের কৌশলগত বিপত্তি ঘটলেও দ্রুত তাদের রাজনৈতিক গঠন প্রক্রিয়ায় সহনশীলতা বজায় থাকায় সহসাই আবার দলবদ্ধ হয়ে যেত। ২০২১ সালে ন্যাটো-আমেরিকার যুদ্ধ পরিকল্পনাকে পরাজিত করে তালেবান গোষ্ঠী যে অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছিল, সেখানে তারা জঙ্গি যুদ্ধকৌশলের পেশাদারত্বের চমকপ্রদ সাফল্য প্রদর্শন করেছিল। কারণ, আফগানিস্তানের মতো দেশে তালেবান যোদ্ধা–জঙ্গি বাহিনী একটি সুসংগঠিত গেরিলা যোদ্ধা বাহিনী হিসেবে প্রমাণ করেছে। এ বাহিনী দেশব্যাপী বড় ধরনের সশস্ত্র জঙ্গি যোদ্ধাদের সমাবেশ ও নিয়োগসক্ষমতার অধিকারী ছিল। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ২০০৬ সাল থেকেই তালেবানরা মাঠপর্যায়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রেডিও ও সেলফোন ব্যবহার করে দেশের সব এলাকার বা অঞ্চলের যোদ্ধাদের সঙ্গে সমন্বয় করে মার্কিন-ন্যাটো ও আফগান সরকারি বাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনার কৌশল অবলম্বন করেছিল। তালেবান যোদ্ধারা জিহাদি উগ্র মতবাদে দীক্ষিত হয়ে জঙ্গি তৎপরতায় নিজেদের উৎসর্গ করতেন। তাঁদের কমান্ডাররা যে ধারণা প্রদান করতেন, যোদ্ধারা তা মাথা ও বুকে ধরে এক মহৎ বাণী বা নির্দেশ আকারে গণ্য করে জীবন উৎসর্গ করার এক জঙ্গি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দৃঢ় অটলভাবে পাহাড়ে, জঙ্গলে, গুহায় অবস্থান করে গোটা আফগানিস্তানে বহুজাতীয় বাহিনী, আফগান সেনা, পুলিশ ও নিরীহ আফগান জনগণকে নির্মমভাবে হত্যা করার মানবতাবিরোধী জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত থাকেন।

কারণ, তাঁরা সহজভাবে স্বর্গে পৌঁছানোর তথাকথিত আদর্শিক প্রতিশ্রুতির নেশার বলে বলীয়ান হয়ে যেকোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করায় পারদর্শী ছিলেন। মসজিদ, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, চলন্ত বাস, কিন্ডারগার্টেন স্কুল—কোনো কিছুই ছিল না তাঁদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বাইরে। তালেবান যোদ্ধারা উন্নত অত্যাধুনিক যোগাযোগযন্ত্রপাতি ব্যবহার করে আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতার মাত্রাকে দিন দিন বাড়িয়ে তোলেন।

আফগানিস্তানের দুর্গম, পাহাড়ি গ্রাম, প্রদেশ ও জেলা শহরে বসবাসকারী অনেক আফগান, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন অজ্ঞ, অশিক্ষিত, নিরীহ, গরিব। তাঁদের মস্তিষ্ককে আরও শাণিত করে কাবুল সরকারের বিরুদ্ধে কাজে লাগায় তালেবান। বহুজাতিক বিদেশি বাহিনীর তালেবান, আল–কায়েদাবিরোধী অভিযানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিরীহ নিরপরাধ সাধারণ মানুষ, শিশুসহ প্রাণহানির ঘটনাগুলো কাজে লাগিয়ে তালেবান জনগণকে উসকানিমূলক বিদেশি সেনা ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, অপছন্দ, বর্বরতার অভিযোগসহ ব্যাপক প্রচার চালায়। নিরীহ, সহজ-সরল আফগান জনগণ তালেবান ও আল–কায়েদার বিষাক্ত বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে যায়। তাদের নিকট একদা বিদেশি অতিথিরা দ্রুতই শত্রুতে পরিণত হয়ে যায়।

তালেবানের ২০২১ সালের ১৬ আগস্টের বিজয়ের অন্যতম কারণ

পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের দরজা তালেবানদের জন্য সদা উন্মুক্ত ছিল। পাকিস্তানের ভূখণ্ডে তালেবানদের জঙ্গি আস্তানা বা ঘাঁটি ২০০১ সালের মার্কিন–ন্যাটোর আফগান অভিযানের পর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান ভূখণ্ড ছিল তালেবানের জন্য নিরাপদ এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) প্রত্যক্ষ পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানে, আদর–যত্নে,œমেহমানদারিতে সুরক্ষিত তারা। ফলে পাকিস্তানের ভূমি থেকে আফগানিস্তানে তালেবানের সব রকম যানবাহন, অস্ত্রশস্ত্র, রসদ অনায়াসেই আফগানিস্তানে প্রবেশ করে আবার তাদের নিরাপদ ঘাঁটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ফিরে যেত। পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গে ভালো সখ্য ও যোগাযোগ থাকায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আফগান তালেবান তাদের জঙ্গি অভিযানকে আরও শক্তিশালী ও জোরদার মজবুত করে তোলে। বিশেষ করে বেলুচিস্তান ছিল আফগান তালেবানের জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। কারণ, ওই পাকিস্তান প্রদেশে আল–কায়েদার উপস্থিতি ছিল সর্বনিম্ন¤এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী ও প্রশাসন তালেবানকে সেখানে লালন–পালন করে বেলুচিস্তানের জাতীয় আন্দোলনকে দমন ও প্রতিহত করার কাজে তাদের ব্যবহার করত। কোয়েটা প্রদেশেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তালেবানকে বেলুচ জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করত। পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশের তিনটি প্রধান যাত্রাপথ বা রুট ছিল এবং এই তিন যাত্রাপথের কোনো প্রকার পরিবর্তন না হওয়ায় আফগান মুজাহিদ বাহিনী ১৯৮০ সালে ব্যবহার করেছিল। ‘পারাচিনার’ নামের রুটটি কাবুলের দক্ষিণে ৯০ কিলোমিটার দূরত্বে ছিল। কাবুলের দক্ষিণের লোগার প্রদেশের আজড়া জেলা বেশ সুবিধাজনক ছিল বিভিন্ন জঙ্গি তৎপরতার জন্য।

পাকিস্তান সীমান্ত থেকে আফগানিস্তানের জাবুল প্রদেশ হয়ে দক্ষিণ ও উত্তর-পশ্চিমে, বিশেষ করে গজনি, ওয়ার্দাক ও লোগার প্রদেশে যাতায়াত ও প্রবেশের জন্য একটি দুরূহ ও জটিল পথ ছিল। কারণ, এ পথে দক্ষিণের কান্দাহার প্রদেশ ও উরুজগান প্রদেশ হয়ে পশ্চিমে হেরাত, বাদগিরিসে যাওয়া-আসার জন্য তালেবানের রুট ছিল। আফগানিস্তানে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলাকে চিরস্থায়ীভাবে চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তালেবান জঙ্গি গোষ্ঠীকে সব ধরনের বুদ্ধিমত্তার গোপন সংবাদ সরবরাহ করে এবং সব ধরনের মারণাস্ত্র সরবরাহ করে তালেবান ও অপর জঙ্গি নেতা হাক্কানি নেটওয়ার্কের কার্যক্রমকে জীবিত রেখেছিল পাকিস্তান। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও মশকরার বিষয় ছিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময় ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে আফগানিস্তানের ভূখণ্ডে ইসলামি স্টেটের একটি আস্তানার গভীর সুড়ঙ্গে ১১ টন ওজন ও শক্তিশালী ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বোমা, মার্কিনদের ভাষায় ‘মাদার অব অল বম্বস’ নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ওই গুহা বা সুড়ঙ্গ থেকে নাকি জঙ্গিরা মার্কিন উপদেষ্টা ও আফগান সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করছিল। পূর্ব আফগানিস্তানে নানগারহারে, পাকিস্তানের সীমানাঘেঁষা ডেরায় বোমাটি নিক্ষেপ করেছিল মার্কিন বিমান থেকে। যদিও আফগান সামরিক কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন, ওই বোমার আঘাতে নাকি তিন ডজনের মতো আইএস জঙ্গি নিহত হয়েছিল। মার্কিন ও আফগান সেনাবাহিনীর কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ও সাফল্যের দাবি করেছিলেন। কিন্তু সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট কারজাই প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘এটা জঙ্গি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, বরং আমাদের দেশের মাটিতে একটি শক্তিশালী বোমার সক্ষমতা পরীক্ষা করার একটি অমানবিক, বর্বর, অসদাচরণ ও অপব্যবহার।’ মার্কিন শাসক ট্রাম্প ও পেন্টাগন কখনোই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গি তালেবান, হাক্কানির সুরক্ষিত ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ওপর বিমান আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে তালেবানের প্রতি সহানুভূতি, সমর্থন, সাহায্য প্রদানকে কোনোভাবেই বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। এমনকি আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে নিয়োজিত মার্কিন–ন্যাটোর তিন-চার তারকা জেনারেলরা, পেন্টাগন, সিআইয়ের উপদেষ্টা, পরিকল্পনাকারী বা তালেবানবিরোধী যৌথ সামরিক–বেসামরিক গোয়েন্দা বাহিনী, সংস্থার কেউই তালেবানকে অস্ত্রশস্ত্র, রসদ, যোগাযোগব্যবস্থা বা তথ্য বেতার নেটওয়ার্কসহ সাপ্লাই রুট—কোনো কিছুই ধ্বংস করে তালেবানের দৈনন্দিন কার্যধারা নস্যাৎ করতে পারেনি। মার্কিন-ন্যাটো এক বিরাট পরাজয়ের তকমার কালিমা সঙ্গে নিয়ে কাবুল ছেড়েছিল ২০২১ সালের আগস্টে।

পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা অব্যাহতভাবে তালেবানকে সর্বাত্মকভাবে সমর্থন প্রদান করায় তালেবানের জঙ্গি কার্যক্রম শক্তিশালী হয়ে বৃহৎ আকার ধারণ করে। পাকিস্তান হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম জঙ্গি ও চরমপন্থীদের উত্থানের প্রকৃত ও আসল অনুপ্রেরণামূলক মূল সূত্র বা হোতা। গত বছরের ১৬ আগস্ট তালেবানের কাবুল দখলের মাধ্যমে ঝটিকা বিজয়ে পাকিস্তানের জংলি উল্লাস ও পাকিস্তান নিরাপত্তাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎফুল্লতা প্রমাণ করে, তারা তালেবানকে যুগ যুগ ধরে সমর্থন ও সাহায্য দিয়ে এবং শক্তিশালী করে আফগানিস্তান পুনর্দখল করার সব কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করেছিল। তালেবানের কাবুল দখল করার কয়েক দিনের মধ্যে বিশেষ বিমানযোগে পাকিস্তান আইএসআইয়ের প্রধান লে. জেনারেল কাইজ হামিদ কর্মকর্তাদের নিয়ে কাবুলে পৌঁছান, সঙ্গী ছিলেন ইমরান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কোরেশিসহ প্রতিনিধিদল। তাঁরা কাবুলে পৌঁছানোর পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, যুদ্ধক্লান্ত দেশটিতে সব ঠিক হয়ে যাবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে আইএসআইয়ের প্রধান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমরা তালেবানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছি আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য।’ তালেবানের বিজয়ে পাকিস্তানি ক্ষমতাসীন সরকারপ্রধান ইমরান খানের হাবভাব ও কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল, যেন পাকিস্তান জঙ্গিদের দ্বারা আফগানিস্তানের ক্ষমতা পুনরায় দখল করিয়ে এক মহাবিজয়ের উপাখ্যান রচনা করেছে। তালেবানের কাবুল দখল ও ক্ষমতায়নের ৮ মাস পর, অর্থাৎ ২০২২ সালের এপ্রিলে ইমরান খান ক্ষমতা থেকে পাকিস্তানের চিরাচরিত প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত হন।

পাকিস্তান আজ ভয়াবহ আর্থিক ও জ্বালানিসংকটে আছে। আফগানিস্তানে পাকিস্তান জঙ্গি–তালেবানকে সাহায্য–সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী করে। ফলে তাদের বর্বরতার শিকার হয় লাখো নারী-পুরুষ ও শিশু। এর দায়ে অভিশপ্ত ও কলঙ্কিত পাকিস্তান শাসক ও সেনা গোয়েন্দা সংস্থা মনে করেছিল, আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা পুনর্দখলে তারা মনেপ্রাণে যা চেয়েছিল, তা–ই হয়েছে। আফগানদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সেই দহরম-মহরম ক্রমেই এক বৈরিতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি আজ এক চরম আর্থিক দুর্যোগ ও নিরাপত্তাহীনতায় আছে। রাষ্ট্রটির জনজীবনে ভয়, আশঙ্কা, অনিশ্চয়তার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে।
কাতারের দোহায় ট্রাম্প প্রশাসন ও তালেবানের মধ্যকার চুক্তি স্বাক্ষর এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সৈন্য অপসারণ আফগানিস্তানে তালেবানের জয়কে ত্বরান্বিত করে।

আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের অভিযান
ফাইল ছবি: এএফপি

২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একসময় যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত জঙ্গি তালেবানের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে এক আত্মঘাতী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই চুক্তিতে কাবুলে আফগান জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির কোনো মন্ত্রী, সদস্য অথবা সামরিক বাহিনীর কেউই উপস্থিত ছিলেন না। অথচ কাবুল সরকারপ্রধানের উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল প্রধান অতিথি হিসেবে তালেবানের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে।

ওই চুক্তির প্রধান শর্তগুলো যেভাবে অনুপস্থিত বা উল্লেখিত ছিল না, যেমন—

.
দীর্ঘ ২০ বছর তালেবানের অধীন বা ব্যবহারকৃত অস্ত্রশস্ত্র বহুজাতিক আফগান সেনাবাহিনীর কাছে সমর্পণের কোনো রকম বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ ছাড়াই একটি সমঝোতামূলক প্রতারণামূলক হাস্যকর চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছিল। চুক্তি মোতাবেক ৫০০ তালেবান মুক্তি প্রদানের পরপরই তাঁরা জঙ্গিদের সঙ্গে মিশে গিয়ে উধাও হয়ে যান। ওই ৫০০ জন কাবুলের বাগরাম বিমানবন্দরের মার্কিন বাহিনীর পরিচালিত সুরক্ষিত কারাগারে বন্দী ছিলেন।

২.
আফগান তালেবান ও পাকিস্তানের তালেবান বা তেহেরিক–ই–তালেবান যমজ ভাই। পাকিস্তানের তালেবানের সঙ্গে আফগান তালেবানের রয়েছে আত্মিক যোগাযোগ ও হরিহর আত্মার সম্পর্ক। আশ্রয় প্রদানসহ তালেবানের সব স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেখভাল করার ইন্ধন ও অন্যতম দায়িত্ব পালনকারী পাকিস্তান সরকার ও তার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কার্যক্রমসহ তালেবানের প্রশিক্ষণ বন্ধ ও কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার দিকনির্দেশনাসহ পাকিস্তান সরকারকে এই তথাকথিত চুক্তির অংশগ্রহণের আওতায় আনয়ন করা হয়নি। পাকিস্তানভিত্তিক তেহেরিক–ই–তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপিকে নিষিদ্ধ ঘোষণাসহ আফগান তালেবানের অস্ত্রসমর্পণের কোনো বাধ্যবাধকতার চিহ্নের মধ্যে আনা হয়নি।

৩.
ওই অমূলক গুরুত্বহীন চুক্তির সব অংশেই শুধু মার্কিন বাহিনীর নিরাপত্তাসহ সব সামরিক ব্যবস্থাপনা, ক্যাম্প বন্ধ, তাদের নিরাপত্তাসহ মার্কিন-ন্যাটোর নিরাপদ প্রস্থানের সব বিষয়েই সম্পূর্ণভাবে তালেবানকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। আফগান সরকার, সেনা, পুলিশ ও সাধারণ জনগণের সর্বাত্মক নিরাপত্তা ও সব ধরনের জঙ্গি তৎপরতায় তালেবান যোদ্ধাদের অংশগ্রহণে পুনরায় এতে লিপ্ত বা জড়িত না হওয়ার নিষিদ্ধকরণ বা ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রমে তালেবান নেতাদের চুক্তিতে আবদ্ধ করা হয়নি।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীর প্রত্যাহারে ট্রাম্প-বাইডেনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মার্কিন জেনারেলদের হুঁশিয়ারি ছিল। ২০২০ সালে কাতারের রাজধানী দোহায় মার্কিন-তালেবান চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরই মার্কিন কিছু তারকাখচিত ও অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারবার্তা দিয়েছিলেন। তাঁদের সবারই মতামত ও প্রতিক্রিয়া ছিল, সম্পূর্ণভাবে মার্কিন সেনা অপসারণ বা প্রত্যাহার করা হলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে এবং পুরো দেশে ধ্বংস নেমে আসবে।

আফগনিস্তানের সাবেক এক কমান্ডার বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী অপসারণ করা হবে একটি মারাত্মক আত্মঘাতীমূলক ভুল পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্রকে এ ভুলের মাশুল প্রদান করে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে একদিন। আমার ভয় হচ্ছে এ ভেবে যে মার্কিন সৈন্য অপসারণের ফলে একদিকে যেমনি শত শত মার্কিন ঠিকাদারের আয় কমবে, তেমনি একটি অসমাপ্ত যুদ্ধ শুধু আরও খারাপের দিকেই এগিয়ে যাবে।’

আফগান সেনাবাহিনীর নৈতিক সাহস ও মনোবলে ভাঙন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশন (সিগার) কাবুল পতনের পরপরই (মে ১৮, ২০২২) এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০২০ সালে ট্রাম্প প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের হঠকারী ঘোষণা এবং ২০২১ সালে বাইডেন প্রশাসন কর্তৃক তা দ্রুত বাস্তবায়নই ছিল একমাত্র অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আফগান প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীর পতনের মূল ও প্রধান কারণ। সিগারের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২০ সালে ট্রাম্প কর্তৃক তালেবানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি আফগান সামরিক বাহিনীর ভঙ্গুর মনোবলকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ পেন্টাগনের ২০ বছর ধরে শুধু মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করাই ছিল মূল লক্ষ্য। কিন্তু তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি।

মার্কিন-তালেবান চুক্তির ফলে মার্কিন বিমান হামলা দ্রুত হ্রাস ও বন্ধ করা হয়
২০২০ সালে স্বাক্ষরিত দোহা চুক্তির ফলে অন্য যেসব বিষয় আফগান নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি করে এবং যার ফলে তাদের মারাত্মক সংকট ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল ২০১৯ সালে মার্কিন বাহিনী যেখানে ৭ হাজার ৪০০ বিমান আক্রমণ পরিচালনা করেছিল তালেবানের অবস্থানের ওপর, সেখানে পরবর্তী বছরে মাত্র ১ হাজার ৬০০ বিমান আক্রমণ হয়। ওই বিমান আক্রমণ মার্কিন-তালেবান চুক্তির দুই মাস পূর্বেই অর্ধেক পরিচালিত হয়।

সিগারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমান আক্রমণে তালেবানের অবস্থানসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করার মাত্রা হ্রাস করার ফলে আফগান সেনাবাহিনীকে একটি অতিপ্রয়োজনীয় সুবিধাজনক রণকৌশলকে ব্যাহত করে তালেবান আল–কায়েদা গোষ্ঠীকে দূরবর্তী অঞ্চলে পালিয়ে যাওয়ার বা ধ্বংস করার কারণ হিসেবে দোহা চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, তালেবানের অবস্থানের ওপর বিমান আক্রমণ পরিচালনা না করার ও তালেবানের মার্কিন সন্তানদের রক্ষা করার কথা। আফগান সেনা বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশ বাহিনীর রক্ষা ও নিরীহ জনগণকে হত্যা না করার তালেবানদের ওপর কোনো বিদেশ চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সাবেক আফগান কমান্ডার জেনারেল সামি সাদাত একবার মন্তব্য করেছিলেন, মার্কিন ঠিকাদারদের আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করার পর রণক্ষেত্রে তালেবানের ওপর বিমান আক্রমণ পরিচালনার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বিমান মেরামত সংরক্ষণকরণ অথবা বিমানবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতার অভাব ও ক্ষতিগ্রস্ত বিমানগুলো অচল অবস্থায় চলে যায়। ফলে তালেবানের অবস্থান ও লক্ষ্যবস্তুর ওপর আফগান বিমানবাহিনীর আক্রমণের পথ বাধাসহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই, ৬০ শতাংশ ব্ল্যাক হক বিমান অচল হয়ে যায়। আফগান সরকার অথবা মার্কিন কর্তৃপক্ষের কারও কোনো উদ্যোগ ছিল না ক্ষতিগ্রস্ত বিমানগুলো মেরামত করে সচল করার। সামি সাদাত আরও বলেছিলেন, ২০২১ সালে ৫ জুলাই যখন কাবুলের উত্তরে বাগরাম বিমানঘাঁটি থেকে রাতের অন্ধকারে নব নিযুক্ত আফগান বেজ কমান্ডারকে না জানিয়ে বিমানঘাঁটিকে সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত রেখে পরিত্যাগ করে চলে যায়, তখন আফগান সেনাবাহিনী শুধু নীরব দর্শক হিসেবে অবলোকন করছিল।

আফগান পুলিশের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ, কিন্তু দোষ সব নন্দ ঘোষদের
২০০১ থেকে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আফগান সশস্ত্র বাহিনী জঙ্গি তালেবান আলকায়দা, আইএসের বিরুদ্ধে গোটা আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ, জেলা, অঞ্চলগুলোয় যুদ্ধ করে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। অকাতর প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন আফগান সেনা পুলিশ নিরাপত্তা বিভাগের সদস্যরা। হাজারো সাধারণ আফগান জনগণের প্রতিটি স্বপন হারা পরিবারের সঙ্গে সেনা পুলিশ সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পরিবারগুলো আজ তাদের পরিবারের প্রধানের অনুপস্থিতিতে দিশেহারা, এতিম। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আকস্মিক মার্কিন সৈন্য অপসারণের হঠকারী ও আত্মঘাতীমূলক সিদ্ধান্তের খবরে আফগান প্রতিরক্ষা ও সেনাবাহিনীর নিকট একটি বজ্রাঘাতের ন্যায় আঘাত করে। আফগান সরকার সেনাবাহিনীর প্রধান ও কমান্ডারদের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো প্রকার আলোচনা না করেই নেয় সিদ্ধান্ত।

মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সরে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যখন আফগান সেনা, পুলিশ বাহিনী প্রাণপণ প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল জঙ্গি তালেবান আল–কায়দার বিরুদ্ধে, তখন তাদের প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র, খাদ্য, রসদ, ওষুধপত্র, চিকিৎসা, অ্যাম্বুলেন্স কোনো কিছুরই প্রয়োজনীয়তা মেটানো হয়নি।

আফগান সেনাবাহিনী যুদ্ধরত অবস্থায় আহত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধের সবকিছু শেষ হওয়ায়, পিছু হটে যায় ও দুর্গম পাহাড়ি উপত্যকায়, আহত অবস্থায় অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। ওই সময় আফগান সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য মার্কিন বাহিনীর কমান্ডারদের কাছ থেকে কোনো প্রকার সহায়তা, বিমান বা যুদ্ধে আহত সেনা সদস্যদের দ্রুত চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি। কারণ, তখন আফগান সেনা ও বিমানবাহিনীর অধিকাংশ হেলিকপ্টার ছিল অচল, অকেজো। মার্কিন তারকাখচিত জেনারেল ও মার্কিন সরকার তখন দোহা চুক্তির তথাকথিত শান্তির চুক্তি, যেখানে বলা হয়েছিল, তালেবানের ওপর আর কোনো আক্রমণ বা আঘাত করা হবে না, ওই অমিয় শর্তের শীতল অনুভূতিতে মশগুল হয়ে, যেকোনো প্রকারে আফগানিস্তান থেকে দ্রুত পলায়নের প্রস্তুতিতে দিশেহারা ও ব্যস্ততায় নিজেদের নিমজ্জিত করে, বাগরাম বিমানঘাঁটিতে দ্রুত অপেক্ষমাণ ছিল। আফগানিস্তান দেশটি ও তার জনগণ, সরকার, সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রতিরক্ষার বিষয় তাদের আর কোনো দায়–দায়িত্ব নেই বা ছিল না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছিল তখন আমার নিকট।

আমার ধারণা, আফগানিস্তানে মার্কিন-ইউরোপিয়ান জেনারেলদের এই ব্যর্থতার ও কাবুল পতনের কারণগুলো যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশে সামরিক ও কৌশলগত প্রশিক্ষণে যথাযথ বিশ্লেষণসহ সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণার্থীদের ধারণা প্রদানসহ, সামরিক বিশ্লেষকদেরও আরও অধিক গবেষণা বিচার–বিশ্লেষণে উৎসাহিত করবে। প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীদের আফগান পতনের বিষয়গুলো আরও উৎসাহিত করে তুলবে তাদের নিজ নিজ পেশাগত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও বাস্তব রণাঙ্গনে। আফগানিস্তানসহ দীর্ঘ দিনের আন্তর্জাতিক সংস্থায় আমার কর্ম–অভিজ্ঞতা ও ক্ষুদ্র চিন্তাভাবনা, পর্যবেক্ষণ ও লব্ধ জ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করতে পাওয়া যায় যে ২০ বছরে গোটা আফগানিস্তানের সামরিক অভিযান ছিল একটি ব্যর্থ, অনুপযুক্ত, অযোগ্য, নিম্নমানের বিচারব্যবস্থা, পূর্ব প্রস্তুতির অভাব, মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করা সত্যের অভাব। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিভ্রান্তি সমন্বয়ের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাব, অল্প অর্জনেই আত্মতুষ্টি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্বকরণসহ আরও বহুবিধ বিষয় ও উপাত্ত যোগ করা যায়। যেমন—
ক. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অমার্জনীয় ভুল ছিল, প্রথমে পুরো সৈন্যবাহিনীর অপসারণ
খ. আফগান সরকারের দ্রুত পলায়ন ও গোটা দেশকে সরকারশুন্য করে যাওয়া
গ. ইউরোপীয়ান সরকার ও সৈন্যবাহিনীর আফগানিস্তানে থাকার অস্বীকৃতি এবং ব্রিটিশ বাহিনীর পাশে থেকে যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত।

ব্রিটেন ও তার শাসক জনগণ সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কর্তব্যচুত বা পরিত্যাগ করার পরিচয় প্রদান করেছে। বছরের পর বছর মার্কিন নেতারা আফগানিস্তানের গুরুত্বকে মূল্যহীনভাবে বিবেচনা করে শুধু মুখরোচক সাফল্যের কথা প্রচার করে যাচ্ছিলেন। আফগান সশস্ত্র বাহিনীর বেশ কিছু অংশ বেশ সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তাদের মধ্যে কমান্ডো বাহিনীরও কয়েকজন ছিলেন। কিন্তু তাদের বীরত্বের কথা এখন পর্যন্ত নথিভুক্ত হয়নি।

পরিশেষে বলা যায়, গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানে তালেবান ও আল–কায়দার আবার ক্ষমতায় আরোহণ ও কাবুল দখল ছিল যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ব্রিটেনের জন্য একটি ভয়ানক বিধ্বংসী ব্যর্থতামূলক পরাজয়, তেমনি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল পাশ্চাত্যের ন্যাটোর গণতন্ত্রের; পতন হয়েছিল নৈতিক শালীনতার এবং সর্বজনীন মানবাধিকারের। আফগানিস্তানে মার্কিন–ন্যাটোর তারকাখচিত জেনারেল এবং মার্কিন–ইউরোপীয়ান সরকার ও রাষ্ট্রপধানদের এই লজ্জাকর ব্যর্থতা ও পরাজয় কেন, কীভাবে হয়েছিল? গত ২০ বছর যার চূড়ান্ত কফিনবাক্সের শেষ ব্যর্থতার কালিমাযুক্ত পেরেক বা খিলটি সংযোজিত হয়েছিল, গোটা বিশ্ব ও গোটা আফগানিস্তানের কালো দিন ও বছর হিসেবে বিবেচিত হবে ২০২১ সালে ১৫ আগস্ট।

*লেখক: কাজী সেলিম, লেখক ও গবেষক