হোমিওপ্যাথি
ইমন: তুই চুরুটটা দিবি কি না বল?
আবুল: না! দিতাম ক্যারে? কষ্ট কইরা সরাইছি কি তুমরারে দিবার লাইগ্যা?
সুমন: দাঁড়া! আম্মা আসুক, তোর খবর কইরা দিমু!
আবুল: আমি তুমরার খবর কইরা দিমু! হালাম্মা ইশকুল থেইক্যা আইলে!
চোরাই চুরুট নিয়ে আমরা দুই ভাই ও বাসার সাহায্যকারী আবুল হোসেনের মধ্যে ব্যাপক বাহাস চলছে। বড় ফুফা অফিসের কাজে এসেছেন। আজকে একটার পর একটা দান মারছে আবুইল্যা।
সকালে বাসায় আসার পরপরই বড় ফুপা আমাদের তিনজনকে লাইন ধরে দাঁড় করান। একজনের পর একজনের চোখের নিচে পর্যবেক্ষণ করে দুফোঁটা করে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ জিবের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন। জিবটা বেশ জ্বলে উঠছে। এই ওষুধ খাওয়ার পারিশ্রমিক হিসেবে প্রত্যেকের হাতে সাতটি করে চিনির গোল গোল দানা দিচ্ছেন। টপ করে মুখে চালান দিয়ে ফুফার কাছে আবার হাত পাততেই আরও দু-তিনটি দানা সরবরাহ করেন।
বড় ফুফা মোস্তাক সাহেব পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট। উনি মাঝেমধ্যে অফিস ও ইনস্টিটিউটের কাজে ঢাকায় আসেন। ওনার শখ হচ্ছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও রাশভারী হওয়ার কারণে রোগীরা ওনার কাছে যেতে ভয় পান। কিন্তু আমাদের ব্যাপার আলাদা। ফুফা আমাদের বাসায় এলে ওনার আশপাশে ঘুরঘুর করি চিনির গোল্লা খাবার জন্য। নানান রকম বাহানা থাকে। আজকে ফুফা নিজে থেকে ডাক্তারি করে মাত্র একবার আমাদের ওষুধ দিয়েছেন। এরপর আবুল আরও তিনবার এবং আমরা দুই ভাই একবার করে চিনির গোল্লা খেয়ে এসেছি।
আবুল স্বাস্থ্যবান। সে কোনো তিনটি রোগের কথা বলে ওষুধ খেল, আমরা অনেক গবেষণা করেও পেলাম না। ইমন একবার পেটব্যথা এবং আমি পাব্যথার কমপ্লেন দিয়ে ফুফার ওষুধ খেলাম। কিন্তু আবুইল্যা কী কী রোগ বলল, সেটা জিজ্ঞেস করলে মুচকি মুচকি হাসে। শেষ পর্যন্ত ফুফাতো ভাই এনাম ভাইয়ের কাছে আবুলের নামে অতিরিক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাবার অভিযোগ দায়ের করি। চতুর্থবারে ফুফার কাছ থেকে ফেল মেরে আমাদের দোষারোপ করতে থাকে আবুল। ফুফা আবুলকে ভয় দেখিয়েছেন অতিরিক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেলে রং কালো হয়ে যায়। এনাম ভাই আরও একটি কমপ্লিকেশন জানালেন, কারও কারও লেজও গজাতে পারে।
আবুল বারবার বিরক্তি নিয়ে বলতে লাগল, ‘দূর! তুমরার লাইগ্যা আমার চোখটা ঠিক হইল না।’
আবুলের এক চোখ লক্ষ্মীট্যারা। এটা নিয়ে সে সব সময় কষ্টের মধ্যে থাকে। বিকেলে আমাদের সঙ্গে সেও মাঠে খেলতে যায়। বন্ধুরা দুষ্টামি করে ‘দেড় ব্যাটারি বলে। আবুল সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যানের মতো চোখের কারুকার্য দেখিয়ে স্লো মোশনে দৌড়ে যেকোনো গাছের মগডালে উঠে যেতে পারত। সেখান থেকে টারজানের মতো করে ও-ও -ও বলে চিৎকার দেয়; আবার বুকের মধ্যে দুমদুম করে কিলও দেয়। সবাই আবুলকে হিংসা করে, তার মতো গাছের এত উঁচুতে আর কেউ উঠতে পারে না।
বড় ফুফার একটা ‘সাত রাজার ধন মানিক’ হোমিওপ্যাথিক বাক্স ছিল। মেইড ইন জার্মানি। প্রতিবার ঢাকায় এলে নিউমার্কেটের জালালাবাদ হোমিওপ্যাথিক ফার্মেসি ও নিউ লাইফ ফার্মেসি থেকে জার্মানির তৈরি সবচেয়ে ভালো হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে যেতেন। আমরা তত দিনে আজিমপুর ছাপরা মসজিদের সিতারা হোমিও হলের ডাক্তার সাহেবের কল্যাণে নাক্স ভোমিকা, আর্নিকা ওষুধের নাম ও কর্মক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে গেছি। ফুফার কাছে আমাদের জ্ঞানের বহর উন্মোচন করলে উনি ভবিষ্যতে ওনার শখের পেশার দু-তিনজন উত্তরসূরি পেয়ে খুশি হন। আর উনি খুশি মানে আমাদের জন্য হোমিওপ্যাথিক চিনির গুল্লি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালাইশ্রীপাড়ার বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক জয়চন্দ্রের নাম তখন জেলা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী আগরতলা পর্যন্ত চলে গেছে। আম্মা আর্টসের ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু আশপাশে শত শত ডাক্তার (!) থাকায় তিনিও নিরাপদ ওষুধ হিসেবে তিন-চারটি হোমিওপ্যাথিক মেডিসিনের নাম জেনে আমাদের সর্দি, জ্বর, পেটব্যথায় এগুলো অ্যাপ্লাই করতেন। কঠোর নজরদারি থাকার পরও প্রায়ই আম্মার ভান্ডারের হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশি থেকে চিনির দানাগুলো গায়েব হয়ে যেত।
বড় ফুফা কর্মোদ্যোগী মানুষ ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পিটি ইনস্টিটিউটের বিশাল কম্পাউন্ডে প্রতিবার আমাদের জন্য বিস্ময় থাকত। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তাক্রুজ ইউনিভার্সিটিতে শুধু প্রাইমারি এডুকেশনের ওপর কোর্সই সম্পন্ন করেননি একই সঙ্গে তৎকালীন আমেরিকার অনেক আধুনিক প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ করেন এই দেশে। তিনি তেলাপিয়ার চাষ করে আশির দশকের প্রথম দিকে এলাকায় নাড়া ফেলে দেন। ডোবার নিচে পলিথিন বিছিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় থাইল্যান্ডের তেলাপিয়া চাষের পদ্ধতি দেখতে পদস্থ কর্মকর্তা ও আগ্রহী মানুষেরা পিটি ইনস্টিটিউটের ভিড় জমাত। ঢাকার নিউমার্কেটের বিশেষ যত্নের টুকরিতে গাজর দেখতাম। সেই গাজর প্রথমবার চাষ করে সফল হওয়ার পর আমাদের ঢাকার আজিমপুরের বাসায় পাঠানোর পর ব্যাপারটা আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। আমাদের ধারণা ছিল শুধু ডেনমার্ক, আমেরিকা, রাশিয়া ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও গাজর উৎপাদন করা যায় না। ব্যাপক আগ্রহ দেখালে এনাম ভাই সহজভাবে বলে দেন, ‘তোমরা মুলাগাছ দেখেছ? গাজরও একই রকমভাবে মাটি থেকে বের হয়। পার্থক্য একটি সাদা, আর অন্যটি লালচে কমলা রঙের।’
বিকেলে বা সন্ধ্যায় যেকোনো সময় পিটি ইনস্টিটিউটের ফুফুর বাসা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনমুখী অথবা ঢাকামুখী ট্রেনের লম্বা হুইসেলের আওয়াজে আমরা উতলা হয়ে উঠতাম। দৌড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখার অপেক্ষায় থাকতাম। সামনের পুনিয়াউটের ধানখেত পার হয়ে কলাবাগানের সারির ভেতর দিয়ে ঝমঝমাঝম শব্দ তুলে ট্রেন- মালগাড়ি চলে যেত। গুনতাম, কয়টা করে বগি আছে? মালগাড়ির জন্য ৩১ বা ৩২টি বগি আর যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য ৯–১০টি বগি থাকত। সন্ধ্যার পর কালীবাড়ি মোড় থেকে কাজীপাড়া ঈদগাহ হয়ে মোড়াইল, পুনিয়াউট, পৈরতলা পুরো এলাকাটাই নির্জন হয়ে যেত। পৌরসভার একটা বা দুইটা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় এই পরিবেশকে আরও রহস্যময় করে তুলত। মাঝে মাঝে শিয়ালের চিৎকার ভীতির সঞ্চার করত। বড় ফুফুর হাতের ডিমের হালুয়া খেয়ে পকেটভর্তি গোলাপি, নীল, হলুদ চক নিয়ে নানাবাড়ির দিকে ফিরতাম। কালীবাড়ির দিকে ঈদগাহ পেরোলেই বাঁ দিকে পরপর কয়েকটি ডোবা আর ডান দিকে একটা পুরোনো আমলের বাড়ির সামনে জোড়া পামগাছ বড় ফুফুর বাসায় যাওয়ার ল্যান্ডমার্ক। অনেক দূর থেকে একটা–দুইটা রিকশার টুংটাং শব্দ আর চলন্ত হারিকেনের আলো মনে সাহস জোগাত।
অবশেষে চুরুট নিয়ে আমাদের তিনজন একটা চুক্তিতে আসায় পারস্পরিক হুমকি বন্ধ হলো। চুক্তি অনুযায়ী ছোট থেকে বড় সবাই একবার করে চুরুটে টান দেবে আর আবুইল্যা চুরুট চুরির পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিবার দুটি করে টান দেবে। ফুফাকে কখনোই একবারে পুরো চুরুট খেতে দেখিনি। ফুফার এই চুরুট স্পেশাল। খয়েরি এই চুরুটের গায়ে লাল একটি স্টিকার। হাভানা চুরুট। একসঙ্গে ২০–৩০টি চুরুট সেলোফেনের কাগজে প্যাক করা থাকে। এটি কিনতে এনাম ভাই গুলিস্তানের দিকে কোন একটি দোকানে যেতেন।
তিনতলার স্বপন ভাইদের বাসায় একটি ওয়েস্টার্ন ছবির পোস্টারে ক্লিন্ট ইস্টউড হাতে যেভাবে সিগার ধরে দাঁড়ায় ঠিক সেই একই ভঙ্গিমায় ইমন চুরুট ধরে পার্ট নিয়ে একটা টান দিতেই কাশতে কাশতে মেঝেতে পড়ে গেল; আবুল এটা নিয়ে খোঁচা দেওয়ার পর আমি ধরালাম। মাথা হঠাৎ করে চক্কর দিয়ে আমিও মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। আবুল একটা টান দিয়ে চুপচাপ মাটিতে বসে গেল, চুরুটটি নিভিয়ে থম মেরে বসে রইল। বোঝা যাচ্ছে, আবুল হোসেনও ফেইল। কদিন আগে মিষ্টি খালারা আবুধাবি থেকে আসার পর খালুর রথম্যান সিগারেটের একটি প্যাকেট সরিয়ে ফেলেছিল আবুল। চুপেচাপে টয়লেটে গিয়ে পুরোটিই সাবাড় করে দিয়েছিল। একদিন হাতেনাতে ধরায় আমাদের একটা করে টান দেওয়ার সুযোগ দেয়। মনে হচ্ছিল, মুখের ভেতর গরম কী যেন একটা ভাপ ও তীব্র দুর্গন্ধ। এটা কীভাবে লোকজন মজা করে খায়?
বিড়ি-সিগারেটখেকো লোকজন অসংখ্য দেখতাম। শ্রমিকশ্রেণির মানুষের কানে গোঁজা থাকত বিড়ি। মাঝে মাঝে কানের ওপর থেকে নামিয়ে ম্যাচবক্স জ্বালিয়ে সুখটান দিত। ‘আবুল বিড়ি’ তখন খুব চলত।
অর্থনৈতিকভাবে আরেক ধাপ ওপরের মানুষ ফিল্টার ছাড়া সিগারেট খেত। বগা, সিজার, স্টার, ক্যাপস্টান এসব সিগারেট বহুল সমাদৃত। এর চেয়ে আরও ওপরের পার্টি ফিল্টার সিগারেট ফুঁকতেন। ফাইভ ফিফটি ফাইভ, গোল্ডলিফ, গোল্ডফ্ল্যাক ছিল খুব চালু আইটেম। আর যাঁরা বিদেশ থেকে আসতেন, তাঁরা নিয়ে আসতেন বেনসন, রথম্যান, মোর সিগারেট।
গ্রামের প্রায় প্রতিটি সাবালক পুরুষ মানুষ হুঁকা টানতেন। এখন হুঁকার খুব একটা চল দেখতে পাই না। হুঁকার মধ্যেও আশরাফ-আতরাফ ভাগ করা ছিল। নারিকেলের পুরো খোলটাকে কালো রং করে এর ওপরে কাঠের তৈরি একটা ফাঁকা টিউব ফিট করে দেওয়া হতো। খোলভর্তি পানি থাকত। এই টিউবের ওপরে থাকত কল্কি। সেই কল্কিতে আরও দুটি অংশ—একটা জ্বালানি ‘টিক্কা’ অন্যটি তামুক (মূল তামাক)। টিক্কা জ্বালিয়ে এর ওপরে তামুক ঠেসেঠুসে দিয়ে নারকেলের একটা ফুটায় জোরে টান দিলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তামাকের ধোঁয়া পানি পার হয়ে সেবনকারী মুখে চলে আসত। একবার টিক্কা জ্বালালে তিন-চারজন কৃষক একজনের পর একজন হাত বদল করে হুঁকা পান করত। আশরাফ শ্রেণির হুঁকাগুলো মেটালের তৈরি। হুঁকার ফুটার অংশ থেকে একটি রাবারের টিউব ২-৩ ফুট দূরের সেবনকারীর ঠোঁট পর্যন্ত চলে গেছে। খুব আয়েশ করে আশরাফ শ্রেণির লোকজন হুঁকায় টান দিতেন—আমজনতা জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকতেন; যদি তাঁদের একটু শরিক করেন! এতে সামাজিকভাবে একটু আপগ্রেডেশন হবে।
* লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।