বিপন্ন জীবন!

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ছেলেটার বিয়ে ভেঙে গেছে!

বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক, কেনাকাটা শেষ, আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করা শেষ, এমন মুহূর্তে এসে বিয়ে ভেঙে গেছে। কেন এমন হলো সে কথা কেউ বলতে পারে না। এমনকি যার বিয়ে ভেঙেছে, সে–ও বলতে পারে না! কিন্তু আমার কৌতূহলী মন সত্যটা জানতে চায়।

ওর নাম আসিফ। আমার সহকর্মী, সমবয়সী এবং বন্ধু। ছিমছাম পরিপাটি, পোশাকে ভীষণ সচেতন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে একসঙ্গে চাকরি করি, পাশাপাশি চেয়ারে বসি। চাকরি হওয়ার এক বছরের মধ্যে আমি বিয়ে করলেও আসিফ বিয়ে করেনি। অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল, সে জন্য নিজেকে গুছিয়ে নিতে কিছুটা দেরি করে ফেলেছে।

কিছু মানুষ আছে যাদের ভালো লাগে না, কিন্তু তারা না থাকলে একটা শূন্যতা তৈরি হয়, খালি খালি লাগে, আসিফ তেমন একটা ছেলে। কাজের মধ্যে হাসি–তামাশা, হইহুল্লোড় করে সর্বদা। অতিরিক্ত হাসাহাসির কারণে বস মাঝেমধ্যেই বিরক্ত হয়, তবে তেমন কিছু বলে না। সবাই যে ওকে পছন্দ করে, তেমনটাও নয়। আমরা বেশি রকম বিজ্ঞান ও সাহিত্যপ্রিয়, সে জন্য আমাদের সম্পর্ক কিছুটা আলাদা।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চাকরি করে বোনকে বিয়ে দিয়েছে, গ্রামে বেশ ভালো একটা বাড়ি করেছে, তারপর নিজের বিয়ের প্রস্তুতি নিয়েছে। একসঙ্গে সাত বছর মিশে যতটুকু বুঝেছি, তাতে ওর কোনো পছন্দ নেই। আবার বিয়ের জন্য সে কোনো মেয়ে দেখতেও যেত না। আমরা বলতাম, এভাবে বিয়ে হবে কেমনে? বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে হবে, খুঁজতে হবে!

বিয়ে নিয়ে ওর দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা আলাদা। কোরবানির গরু দেখার মতো করে মেয়ে সে দেখবে না। ও বিশ্বাস করে, কোনো মেয়েকে দেখে অপছন্দের কথা বললে তার অন্তরাত্মায় আঘাত লাগে। শুধু মেয়ে নয়, তার পরিবারও আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আমি অবশ্য এ কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোনো যুক্তি পাই না।

মেয়ের পরিবার থেকে উপহার নেওয়ার কথা অকল্পনীয়। ওর কথা, একটা মেয়েকে মা–বাবা কত আদর ও যত্ন করে বড় করেছে, শিক্ষিত করেছে, তারপর সেই মেয়েকে আমার কাছে দেবে, এর চেয়ে বড় কোনো উপহার হতে পারে না! বিয়েতে আমন্ত্রিত অতিথিদের থেকেও কোনো গিফট নেবে না। এমন নয় ও অর্থনৈতিকভাবে একেবারে বেশি সচ্ছল, কিন্তু সে উপহারের চেয়ে অতিথিদের কাছ থেকে অনাগত জীবনের জন্য অনেক বেশি আশীর্বাদ প্রত্যাশা করে।

মেয়ে না দেখলেও বিয়ে নিয়ে আসিফের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। বউয়ের জন্য গয়না বানিয়েছে, নূপুর বানিয়েছে, বিয়ের পরে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য অল্প অল্প করে কিছু টাকা গুছিয়েছে, দেনমোহর দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের নোট সংগ্রহ করেছে। মাঝেমধ্যে হাসতে হাসতে বলেছে, মেয়ের বয়স যে কয় বছর হবে, সেই কয় দেশের নোট তাকে দেনমোহর দেব! আসিফ আরেকটা কথা প্রায়ই বলত, দুজনে মিলে সংসার সাজানোর মধ্যেই নাকি দাম্পত্যের সবচেয়ে বেশি সুখ লুকিয়ে থাকে।

আবার গ্রামের সাধারণ ধার্মিক পরিবারের ছেলে হয়েও নারীর ক্ষমতায়নকে প্রমোট করেছে। সব সময় বলেছে, তার বেটার হাফ যদি চাকরি করে, তাহলে সে সর্বাত্মক সাপোর্ট দেবে। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলেছে, এ দেশের অধিকাংশ কর্মজীবী মেয়েরা ছেলেদের থেকে বেশি কাজ করে। অফিস শেষ করে গৃহস্থালি, বাচ্চা, স্বামী, শাশুড়ি সামলায়! এটা নিয়ে আসিফের সঙ্গে প্রায়ই আমার দ্বিমত হতো।

অতঃপর আমাদের ব্যাচেলর আসিফ একটা মেয়ে দেখতে গেল। মেয়েকে দেখার পরে তার আচরণ, কথাবার্তায় বেশ পরিবর্তন এল। সম্ভবত পছন্দ হয়েছে। কয়েক দিন পরে আমাকে বলল, জীবনে এই প্রথম কাউকে ভালোবেসে একগুচ্ছ গোলাপ আর চকলেট কিনে দিয়েছি।

তারপর মোটামুটি সব ঠিকঠাক। পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায় বিয়ের কেনাকাটা, দাওয়াতপত্র, যাবতীয় কাজ একাই সামলে নিতে হয় আসিফের। এর ফাঁকে ফাঁকে সেই মেয়ের সঙ্গে কফি খেতে যায়। কেনাকাটাও হয়তো দুজনেই মিলে করে। এটা আমাকে বলেনি, তবে একদিন বিকেলে ওকে বেনারসিপল্লিতে একটা মেয়ের সঙ্গে দেখেছিলাম। অবচেতন মনেই বলেছিলাম, দুজনকে বেশ মানিয়েছে।

আসিফ অবশেষে অফিস থেকে বিয়ের ছুটি নেয়। আমাদের সবাইকে দাওয়াত দেয়, গিফট দিতে নিষেধ করে। আমরা অনেক কিছু নিয়ে ঠাট্টা করলাম, লজ্জা দিলাম। দল বেঁধে বিয়ের দাওয়াত খেতে যাব বলে কথা দিলাম।

অফিসের মেয়ে সহকর্মী কীভাবে সাজুগুজু করবে, কেমন শাড়ি পরবে এসব নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন বস সবাইকে ডেকে বলল, আসিফের বিয়ে হচ্ছে না! এটা কীভাবে সম্ভব, আকস্মিক এমন কথা শুনে আমরা সবাই হতভম্ব!

এর দিন তিনেক পরে আসিফ বিধ্বস্ত অবস্থায় অফিসে আসে। সবাইকে ডেকে দুঃখ প্রকাশ করে কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারে না, হু হু করে কেঁদে দেয়। আমরাও কিছু জিজ্ঞাসা করি না।

তার পর থেকে অফিসে আর চিত্কার–চেঁচামেচি নেই। আসিফ অফিসে আসে বাসায় যায়। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কারণ জানতে পারিনি। একদিন শুধু এটুকু বলল, ‘মেয়ের বাবা ফোন করে আমার বাবাকে বলেছে এ বিয়ে হবে না। কোনো কারণ ব্যাখ্যা করেনি।’ আমি তো কোনো অন্যায় করিনি, তাহলে আমার এমন হলো কেন? ওর এ প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি।

এর মাস দুই পরে বস সবাইকে ডেকে বলল, আজকেই আসিফের শেষ অফিস। গত মাসে ও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, আমাকে অনুরোধ করেছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গোপন রাখতে এবং ফেয়ারওয়েল না দিতে। কেউ কোনো কথা বলল না। একটু পরে পিৎজা এল কিন্তু আজকে কেউ খাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল না। সবার চোখ ছলছল করছে। কেঁদে ও কাঁদিয়ে নিভৃতে, নিঃশব্দে বিদায় নিল সবচেয়ে হাস্যোজ্জ্বল সহকর্মী। সাত বছরের চাকরির জীবনে যে সহকর্মীদের নিয়ে আড়ালে–আবডালে একটাও খারাপ কথা বলেনি।

আজ বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম আসিফকে বিদায় জানাতে। পড়াশোনা করতে আমেরিকা যাচ্ছে সে। ওকে বিদায় দিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হই। মনে মনে চিন্তা করি, আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত! এদিক–সেদিক হলেই জীবন বিপন্ন হয়ে যায়। যে ছেলে মা, মাটি দেশ না ছাড়ার উপদেশ দিত, সে আজ স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে আসিফের জন্য। ওর কালজয়ী উক্তিগুলো মনে পড়ে,
কষ্টের রং এক এবং অভিন্ন!
ভালোবাসার কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই!
খারাপের কোনো নারী–পুরুষ বিভেদ নেই!
ইতিমধ্যে গাড়ি অফিসে চলে এসেছে। গাড়ি থেকে নামতে নামতে প্রতিজ্ঞা করি, যেভাবেই হোক এ বিয়ে ভাঙার কারণ আমি অনুসন্ধান করে বের করব!