লাল মরিচে অপরূপা পঞ্চগড়ে একদিন

ছবি: তারিফ দ্য ট্রাভেলার

‘কাইঞ্চাইত গাড়িনু আকাশি আকালি, আকালি ঝুম ঝুম করে রে বন্ধুয়া, আকালি ঝুম ঝুম করে’
বাহ গানটা তো দারুণ!  
কিন্তু ‘আকালি’ আবার কী ভাই?
গান শেষ হতেই শাওন পারভেজ ভাইকে প্রশ্ন করে বসলাম আমি।
আরে কামিল তুমি এই গান আগে শোননি?
এটি উত্তর জনপদের খুবই জনপ্রিয় একটি ভাওয়াইয়া গান। এখানে ‘আকালি’ অর্থ  মরিচ আর ‘কাইঞ্চা’ মানে হলো উঠান।

শাওন ভাই বাংলাদেশ বেতারে কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই আড্ডা দেওয়া হয়। কখনো নদীর পাড়ে তো কখনো খোলা মাঠ বা বড় কোনো গাছের ছায়ায় হুটহাট গিয়ে বসে পড়ি আমরা। অফিসের কাজ, ব্যস্ততা ও যান্ত্রিক জীবনের যন্ত্রণা কমাতে আমাদের এই সিদ্ধান্ত বেশ কাজে দিয়েছে। মুঠোফোনে বাংলাদেশ বেতারের অ্যাপ নেওয়া আছে। আড্ডার কিছু সময় আমরা বেতারেও কান পেতে রাখি।

সেদিন বসে ছিলাম ঠাকুরগাঁওয়ের সুক নদীর পাড়ে। সেখানে সবুজ ঘাসে বসে শান্ত বাতাসের পরশ নিচ্ছিলাম। পাখির কিচিরমিচির, বেতারের ছন্দ আর শাওন ভাইয়ের কথার মাঝে হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠল। ফোন দিয়েছে খুব কাছের এক ছোট ভাই। ওর নাম তারিফ, এই ছেলের আবার ভ্রমণ ও ফটোগ্রাফির নেশা আছে। ভ্রমণের নেশা আমারও আছে। সময় পেলে ওর সঙ্গেও ঘুরতে বেরোই আমি।

ভাই আগামীকাল শুক্রবার, আপনি কি ফ্রি আছেন?
ফোন রিসিভ করতেই তারিফের ব্যস্ত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।
হুম, কেন বলোতো? কোথাও নিয়ে যাবে নাকি?
বললাম আমি।
জি ভাই সময় থাকলে চলেন কালকে পঞ্চগড় থেকে ঘুরে আসি।
ওর কথা শুনে যা বুঝলাম, আগামীকাল সে আমাকে পঞ্চগড়ের আটোয়ারি উপজেলায় নিয়ে যেতে চায়।

উদ্দেশ্য হলো মরিচের ছবি তোলা। শুনেছি, প্রচুর মরিচ চাষ হয় সেখানে। এখন চলছে মরিচ শুকানো আর উত্তোলনের কাজ।

শাওন ভাইকে বললাম, ভাই ব্যাপারটা কি কাকতালীয়? মরিচ নিয়ে কথা বলতে বলতেই সেখানে যাওয়ার জন্য কল চলে এল!

মরিচ শুকানোর দৃশ্য কিন্তু অসাধারণ। যাও দেখে আসো বেশ ভালো লাগবে তোমার। বললেন শাওন ভাই।

আমি বললাম তথাস্তু, এমন সুযোগ পেলে আমি কখন ওই হাতছাড়া করি না।
শুক্রবার সকাল নয়টায় আমরা ঠাকুরগাঁও থেকে মোটরসাইকেল যোগে রওনা হলাম। রুট পরিকল্পনা হলো ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া উপজেলা হয়ে পঞ্চগড়ের আটোয়ারী, মির্জাপুর গ্রামে। সেই মোতাবেক বাইক চালানো শুরু করলাম। বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। সকাল সকালই গ্রীষ্মের দাপট কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছিল। পাম্পে ফুয়েল নিতে নিতে তারিফকে বললাম খুব রোদ হবে তো মনে হচ্ছে? ছবি তোলা আর ঘোরাঘুরিতে বেশ অসুবিধাই হয়ে যাবে আজ।

তারিফ বলল, বের হয়েই যখন পড়েছি, ভাই এখন আর আবহাওয়া দেখে লাভ নেই ।
হুম তাই তো, চলো যাওয়া যাক আর কি।
বললাম, আমি।

ছবি: তারিফ দ্য ট্রাভেলার

রুহিয়ার রাস্তায় বেশ কিছুটা এগোতেই ছোট–বড় মরিচখেতের দেখা মিলল। মিল–চাতালে শুকাতে দেওয়া মরিচ আর দুপাশে লাল–সবুজের খেত ঘন হয়ে আসতে দেখেই বুঝতে পারলাম, আটোআরীর কাছাকাছি চলে এসেছি। আমরা সকালে নাশতা করিনি। এদিকটায় তেমন ভালো কোনো হোটেল পেলাম না। অগত্যা একটা টং দোকানে দাঁড়িয়ে দুই প্যাকেট বিস্কুট খেলাম। সূর্য তখন উত্তাপ ছড়ানো শুরু করেছে। কাঠফাটা রোদের তাপ বলতে যা বোঝায়, ঠিক তা–ই। দোকানটির সামনেই বেশ বড়সড় একটি মরিচখেতের দেখা মিলল। দূর থেকে দেখলাম, সেখানে নারীরা মরিচ তুলছেন। তারিফ বলল, ভাই এখানে কিছু ছবি তুলে নেওয়া যাক। একদম ‘র’ ফটো হবে। ভালো মতো নিতে পারলে গ্রামের নারীদের জীবনসংগ্রাম ফুটে উঠবে ছবিটায়। বাইকটা দোকানের সামনে রেখে, খেতের দিকে এগিয়ে চললাম আমরা।

সবুজ পাতার মাঝে উঁকি দিয়ে হাসছে পাকা লাল লাল মরিচ। সূর্যালোকে সবুজ পাতার ঘোমটা পরা লাল মরিচগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগছে। প্রকৃতির করা একদম নিরেট রং। দেখতে তো ভালো লাগবেই। প্রতিটি গাছেই মরিচভর্তি। এই খেতটায় পাশাপাশি দুই ধরনের মরিচ দেখলাম। উত্তোলন কাজে নিয়োজিত এক আপার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, তুলনামূলক ছোট যে মরিচটি এখানে রয়েছে, সেটির নাম জিরা বিন্দু। আরেকটির জাত হলো হক মাস্টার। প্রতি কেজি মরিচ তুলতে তাঁরা ১০ টাকা মজুরি পেয়ে থাকেন। একজন দিনে মোটামুটি এক মণ পরিমাণ মরিচ তুলতে পারেন, সেই হিসাবে দৈনিক প্রায় চার শ টাকা পেয়ে থাকেন তাঁরা। এই প্রখর রোদে কাজটি বেশ কষ্টসাধ্য। তারিফ ঠিকই বলেছে, আসলেই তাদের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা না জানালেই নয়। শুধু করপোরেটেই নয় পুরুষের পাশাপাশি এই অজপাড়াগাঁয়ের নারীও অর্থ উপার্জন করে সংসারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। যা পত্রপত্রিকা বা টিভি চ্যানেলে তুলনামূলকভাবে কমই উঠে আসে।

মরিচের জাতের স্থানীয় নামগুলো শুনে বেশ মজা পেয়েছি ,এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জিরা বিন্দু, হক মাস্টার, বাঁশগাইয়া ইত্যাদি।

তারিফের ছবি তোলা শেষে আবার যাত্রা শুরু করলাম আমরা। এবারের উদ্দেশ্য হলো মরিচ শুকানোর দৃশ্য দেখা ও ছবি তোলা।

কিছু দূর এগোতেই পথের পাশে, মিল–চাতালে, পুকুরপাড়ে, আমবাগানে যেদিকেই চোখ যায়, প্রায় সবখানে দৃশ্যমান হলো রক্তিম আভা ছড়ানো লাল মরিচ। যেন কেউ এই অঞ্চলে ছোট–বড় লালগালিচা বিছিয়ে রেখেছে। সবুজ মাঠের পাশে রাখা মরিচের লালগালিচার অদ্ভুত শোভা মোহিত করছিল আমাকে। আমি থামতে চাইলে তারিফ বলে উঠল ভাই, সামনে মির্জাপুরে একটা বড় মাঠ আছে, একবারে ওখানেই থামি চলেন। সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মরিচ সেখানেই শুকানো হয়। আরও মিনিট দশেক বাইক চালিয়ে কয়েক শ মরিচের লালগালিচা পার হয়ে আমরা যখন মির্জাপুর মাঠে পৌঁছালাম, তখন ঘড়িতে সময় প্রায় ১২টা। মাঠের দৃশ্য দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! বেশ কয়েকটি ছোট বড় মরিচের ঢিবি, আর মাঠজুড়ে শুকাতে দেওয়া হয়েছে মরিচ। বাতাসে ঝাঁজালো গন্ধ। নাক দিয়ে নিশ্বাস নিলেই শুকনা মরিচের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে এখানে। অনেক মানুষকে দেখলাম মরিচ পাহারা দিতে, কেউবা আবার বস্তায় ভরছেন। এত মরিচ আমি একসঙ্গে কখনো দেখিনি। তারিফ ড্রোন উড়িয়েছে আকাশে। পঞ্চগড়ের কৃষকের মুখের হাসি ফোটানো এই শুকনা মরিচকে বলা হয় ‘লাল সোনা’। বেশ কিছু ছবি তুললাম আমিও। আমার অবাক হওয়া দেখে স্থানীয় একজন জানালেন, এখানকার থেকেও বেশি মরিচ নাকি হাটে ওঠে। সেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা এসে নিয়ে যান। বেশ বড়সড় কারবার। এখন সবচেয়ে ভালো মরিচের দাম মণপ্রতি ৯ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমরা ছবি তুলছি দেখে সেখানে একজন বললেন পাশেই একটা দিঘি আছে, সেটার পাড়েও মরিচ শুকাতে দেওয়া হয়। সেখানকার দৃশ্য নাকি আররো সুন্দর। তারিফকে বলতেই ও বলল, হুম ভাই আমি ফিরোজ আল শাবাহ (পঞ্চগড়ের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার) ভাইয়ের তোলা একটা ছবি দেখেছি, দীঘির পাড়ের। অসাধারণ লাগে, চলুন দেখে আসি আমরা।

ছবি: তারিফ দ্য ট্রাভেলার

দীঘিটির নাম নয়া দীঘি, বেশ বড়সড়, তবে গ্রীষ্মের চরম দাপটে পানির পরিমাণ নামমাত্র। পানিতে চোখ যাবার আগেই আমার চোখ আটকে গেল চারপাশে শুকাতে দেওয়া মরিচের নয়নাভিরাম দৃশ্যে। এখানে বাঁশঝাড় আর গাছপালার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া মেঠোপথ আর দীঘি সব মিলিয়ে স্থানটির শোভা অসাধারণ লাগল। তারিফ যথারীতি তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, দীঘির পাড়ে কজন শিশু ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। হঠাৎ করেই মনের মধ্যে রাজশাহীর পদ্মা পাড়ে বসে আমার শৈশবের সেই ঘুড়ি ওড়ানোর স্মৃতি ভেসে উঠল। ওদের থেকে একটা ঘুড়ি নিয়ে ওড়াচ্ছিলাম। তারিফ এসে বলল, ভাই আমার কাজ শেষ, চলুন এবার যাওয়া যাক।

মরিচের এই লাল চাদরের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে করতে কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে, তা আমরা বুঝতেই পারিনি। সমতল ভূমির চা–বাগানের অদ্ভুত সৌন্দর্য, শীতকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নুড়িপাথর তোলার অসাধারণ দৃশ্য দেখেছিলাম পঞ্চগড়ে। এবার মাঠে–ঘাটে ছড়ানো শুকনা লাল মরিচের সৌন্দর্যে হিমালয় কন্যার আরেক রূপ দেখা হলো আমার। ফিরতি পথে পঞ্চগড়ের বোদা হয়ে ঠাকুরগাঁও যাব আমরা। ভিন্ন রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার উদ্দেশ্যেই আমাদের এই পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। জারুল, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ার মায়াঘেরা অপরূপা পঞ্চগড় সারা দিনের প্রখর রোদ–তাপের কষ্ট ও গরমের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছে আমায়।

*লেখক: নুরুল্লাহ কামিল