পেনশনবৈষম্যের সঙ্গে কোটাবৈষম্যের কথা বলবে কে?
দেশের সর্বোচ্চ উচ্চশিক্ষার কারিগর হলো বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের। দেশের ভাবমূর্তি কেমন, তা দেখার জন্য পুরো দেশ ঘুরে দেখার প্রয়োজন নেই। যেকোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দেখলেই দেশের পরিবেশ ও ভাবমূর্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মানী দিয়ে সম্মানিত করলে শিক্ষার মানের সঙ্গে দেশেরও উন্নয়ন হয়। আজকে যাঁরা দেশ পরিচালনা করছেন, তাঁরাও কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ভবিষ্যতেও যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হবেন। তাঁদের ভালো মানের শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ভালো মানের পরিবেশ ও শিক্ষা। সেই ভালো মানুষ তৈরি করবেন শিক্ষকেরা। সুতরাং তাঁদের সমস্যা মানে গোটা জাতিরই সমস্যা।
নতুন অর্থবছরের (২০২৪-২৫) শুরুর দিন চালু হয়েছে সর্বজনীন পেনশন। এই পেনশন সবার জন্য কার্যকর। স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীনে অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ, সরকারি ব্যাংক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, পেট্রোবাংলা, সাধারণ বীমাসহ প্রায় ৪০০ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এই পেনশনের আওতাভুক্ত হবে। কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এই পেনশনের বিরোধিতা কিংবা আন্দোলনের ঘোষণা বা কর্মসূচি দেয়নি; শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এই প্রত্যয় পেনশনকে বৈষম্যমূলক বলে আখ্যা দিয়েছে। কেননা এতে তাদের আগের যে সুবিধাগুলো ছিল, সেগুলো থেকে তারা বঞ্চিত। তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক পেনশনের জন্য সর্বাত্মক কর্মসূচি পালন করছে। যে সুবিধাগুলো তারা পেত, তা হলো পেনশন পেলেও বেতন থেকে টাকা কাটা হতো না। কিন্তু বর্তমানে বেতন থেকে টাকা কাটা হবে। অধ্যাপক গ্র্যাচুইটি বা আনুতোষিক বাবদ এককালীন পেতেন ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, যা বর্তমানে প্রত্যয় পেনশনে নেই। বেতন থেকে টাকা না কেটে অধ্যাপকের মাসিক পেনশন ৪৫ হাজার ৭৯০ টাকা ছিল। বর্তমানের পেনশনে বেতন থেকে কেটে মাসে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা। আগের পেনশন অনুযায়ী চাকরিজীবী ও নমিনি আজীবন পেনশন পেতেন, যা বর্তমানে পেনশনার আজীবন পাবেন, কিন্তু তিনি মারা গেলে নমিনি পাবেন ৭৫ বয়স পর্যন্ত। নানান সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে সরকারি চাকরিজীবীদের। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও। আগের পেনশনে বছরে পেনশন বাড়ত ৫ শতাংশ করে বর্তমান প্রত্যয় পেনশনে তা আর বাড়বে না। অর্জিত ছুটির জন্য বিপরীতে টাকা পাওয়া যেত এখন এই ব্যবস্থা নেই। মাসিক চিকিৎসা ভাতা, দুটি ঈদের উৎসব ভাতা ও একটি বৈশাখী ভাতা তাঁরা সম্মানী পেতেন, যা নতুন প্রত্যয়ে কিছু বলা নেই। কিছু বলা নেই মানে হচ্ছে তা বাধ্যতামূলক নয়। শিক্ষকদের অবসরের বয়স ছিল ৬৫, কর্মকর্তাদের ৬২ ও কর্মচারীদের ৬০ বছর, যা বর্তমানে সবার জন্য প্রযোজ্য ৬০ বছর।
এখনকার মাসে যে টাকা পাওয়া যায়, নতুন পেনশনে তার থেকে ২.৭ শতাংশ বেশি পাবেন। তার জন্য সবার বেতন থেকে টাকা কাটা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের থেকেও টাকা কাটা হবে। আগে কাটা হতো না। এরই ফলে এবং উপরিউক্ত কারণে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি মধ্যে ৩৫টি সর্বাত্মক বন্ধ দিয়েছে। ক্লাস, পরীক্ষা, অফিস সবকিছু বন্ধ। একযোগে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করেছে। সর্বাত্মক বন্ধের ঘোষণায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে নয়, দেশের প্রতিষ্ঠানের মান ক্ষুণ্ন হবে। আন্তর্জাতিক মান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরও দূরে সরে যাবে। বৈশ্বিক শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি অনীহা চলে আসবে। করোনার প্রকোপে যারা পিছিয়ে ছিল, তাদের জন্য বাধা হিসেবে দাঁড়াবে। বিশেষ করে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা এই বন্ধের রেশ টানতে হবে। অনেকেই বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির প্রস্তুতি নিয়েছিল। একাডেমিক পরীক্ষা শেষ হলে পুরোপুরি চাকরির পরীক্ষা দেবে। কিন্তু এই সর্বাত্মক বন্ধের ঘোষণার জন্য পরীক্ষা পিছিয়েছে। কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা শুরু হলেও এখন স্থগিত। আর কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার রুটিন তারাও পরীক্ষা পিছিয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা।
এখন আসি আসল কথায়, যে বৈষম্যের কথা শিক্ষকেরা বলছেন তার চেয়ে ঢের বৈষম্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েক দশক ধরে হয়ে আসছে। এর জন্য নানা মহলে সমালোচনাও করে আসছে। বলছিলাম কোটার কথা। সাধারণ পেনশনের আওতায় পড়ে বৈষম্যের কথা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বাত্মক বন্ধ ও আন্দোলন করছেন; অথচ কোনো দিন কোটা নিয়ে বা কোটার যৌক্তিকতা নিয়ে নৈতিক মূল্যবোধ দায়িত্ব থেকে কোনো দিন টুঁ শব্দটিও করেননি। কোটার প্রয়োজন আছে কি না, থাকলে কতটুকু প্রয়োজন, বা কাটছাঁটের প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে কোনো ন্যায্য কথা বলেননি। একজন জাতির শিক্ষক হলে কোনো দিন ওটা নিয়ে কথা বলেননি। সাধারণ শিক্ষক শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াননি। তাদের মা-বাবার পকেটের টাকা আপনাদের পকেটে কি ঢোকেনি? যে বৈষম্যের কথা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা বলছেন, সেই বৈষম্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিতে সঙ্গে হয়ে আসছে। ১ হাজার ৪০০তম হয়েও আসন পায়নি। অথচ ২ হাজারের পরে মেধাতালিকায় থেকে আসন পেয়েছে। সেটা কি বৈষম্য নয়? নিজেদের বেলায় ষোলো আনা অন্যের বেলায় এমন বৈষম্য!
লেখক: শহীদুল ইসলাম (শুভ), শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়