পঞ্চগড়ের শ্রমিকদের ভাগ্য কি বদলাবে

ভোরের সূর্য উঁকি দেওয়ার আগেই নদীতে নেমে পড়েছেন হরজোত। তেঁতুলিয়া তখন ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে জড়সড়, ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে চারপাশ। এরই মধ্যে হরজোত বেরিয়ে পড়েন জীবিকার সন্ধানে। আগে তিনি চাকরি করতেন পঞ্চগড়ের চিনিকলে, সে কল বন্ধ হওয়ার পর উপায় না পেয়ে পাথর তোলাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এখন শীতের প্রকোপ আর মহানন্দার হাড়হিম ঠান্ডা পানির তোয়াক্কা না করেই সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা পাথর তুলবেন এই পাথরশ্রমিক। এই-ই তাঁর প্রতিদিনের ‘রুটিন ওয়ার্ক’।

হরজোত একা নন, তাঁর মতো শতাধিক পাথরশ্রমিক এই মহানন্দায়। পঞ্চগড়ের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীটিতে ভারত থেকে ভেসে আসা পাথরের ওপর ঘুরছে এসব মানুষের জীবনের চাকা। সনাতনী পদ্ধতিতে হাতে-কোদালে নদীর বালু খনন করে তোলা হয় বালু। সেই বালু চালুনিতে ছেঁকে বের করা হয় বিভিন্ন আকৃতির পাথর। শুকানোর পর এসব পাথর বিক্রি হয়। এসব পাথর বেচে দৈনিক আয় কখনো পাঁচ শ হয়, কখনো দুই শও হয় না। এককথায়, এই অমানবিক পরিশ্রমেও কোনো নিশ্চিত মজুরি নেই।

হরজোতের সঙ্গে কাজে যোগ দিয়েছেন চান মিয়া। কথা এগিয়ে চলল তাঁদের সঙ্গে। চান মিয়া জানান, তিনি এ পেশায় আছেন ২০ বছর ধরে। বড় কষ্টের খাটুনি এই কাজ। ভারী ভারী পাথর খুঁড়ে বের করতে জীবন বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। যাঁরা পাথর ভাঙার কলে কাজ করেন, তাঁদের অবস্থা আরও করুণ, মজুরি অতি সামান্য। কলের মজুর অধিকাংশই নারী, আর পাথর তোলেন পুরুষেরা।

তাঁরা জানান, পঞ্চগড়ে সমতলের চা-বাগানগুলোয় কাজ করা অধিকাংশ নারী শ্রমিকদের অবস্থা পাথরশ্রমিকদের চেয়েও খারাপ। তাঁরা সারা দিন চা-পাতা সংগ্রহ করেন। প্রতি কেজি চা-পাতার জন্য পান ৪ টাকা। দিনে গড়ে ৩০ কেজি চা-পাতা তুলে এসব নারীর দৈনিক আয় হয় বড়জোর ১০০ থেকে ১২০ টাকা। ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে এ দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।

চান মিয়া বলে চলেন, হরজোতও সঙ্গ দেন। তাঁদের কথায়, পেটে ক্ষুধা আছে, তবে তাকে পাত্তা দিলে চলে না। মহানন্দায় এই পাথর তোলার কাজ করেন যাঁরা, অসুখ তাঁদের নিত্যসঙ্গী। দিনের বেলা পাথর তুলে রাতে গায়ের ব্যথায় ঘুমোতে পারেন না। সারা দিন পানিতে কাজ করায় জ্বর-সর্দি সারা বছর লেগেই থাকে, সেসবের হিসাব করলে চলে না তাঁদের। তবে বিপত্তি হয় যদি কেউ গুরুতর রোগে শয্যাশায়ী হয়ে যায়, তাহলে তাঁর সংসারের চাকা ঘোরাই বন্ধ।

শুধু অসুস্থতা বা অনিশ্চয়তাই নয়, আছে নিরাপত্তার ঝুঁকিও। নদীর ওপারে ভারত। সীমান্তে শ্যেনদৃষ্টি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের। প্রায়ই পাথর তুলতে গিয়ে বেগ পেতে হয়। মাস দুয়েক আগেই বিএসএফের গুলিতে প্রাণ গেছে এক পাথরশ্রমিকের।

জানতে চাইলাম, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কোনো সহায়তা শ্রমিকেরা পান কি না। নিছক প্রশ্ন বুঝিয়ে দিয়ে হরজোত হেসে ফেললেন, পাশে থাকা চান মিয়া উত্তর দিলেন, ‘সাহায্য তো দূরের কথা, কোনো দিনও দেখিয়ে নাই কাখো! ভোট দিয়া হামার কী! থাকিলেই কী, বদলাইলেই কী!’

নিজেরা অমানবিক পরিশ্রম করলেও সন্তানদের এ পথে আনতে চান না তাঁরা। কারণ? হরজোত বললেন, ‘নিজেরা করি তো বুঝিছি, এইলা কামোত হাড়ভাঙা খাটুনি, কষ্ট খুব। এইলা ছোয়ালরা না করুক।’ কিন্তু পড়ানোর সাধ্য? তা-ও তো নেই। তাদের ভাষ্যে, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনো এ শ্রমিকদের সন্তানেরা অধিকাংশই গার্মেন্টস, বালুশ্রমিক, ভ্যান-রিকশাচালক বা হোটেলবয় হিসেবে কাজ করে। এখানে এই-ই অলিখিত নিয়ম, দারিদ্র্যের জনপদে এগুলোই প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গিয়েছিলাম হিমালয়কন্যা কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য দেখব বলে। দেখা তার পাইনি, কিন্তু যে বিষণ্নতা নিয়ে ফিরেছি, তা ভাবাচ্ছে বারবার। বাংলাদেশে গত এক দশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিপ্লব সাধিত হয়েছে, সন্দেহ নেই। ভৌত উন্নয়নও কাগজে-কলমে-পরিসংখ্যানে সন্তোষজনক। কিন্তু কাজীর যে গরু খাতায় আছে, আজও উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলগুলোয় তার দৃশ্যমানতা নেই। সরকারের একের পর এক মেগা প্রজেক্ট চান মিয়াদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরে এমন শত শত হরজোত-চান মিয়া আজও অনিশ্চিত অর্থনৈতিক নিরাপত্তার গণ্ডিতে আটকে। পঞ্চগড়ের দুই উদীয়মান সম্ভাবনাময় পাথরশিল্প এবং চা-শিল্প—কোনো শিল্পের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নেই কাজ করা হয়নি কখনো। রাজনৈতিক বিবর্তন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি বা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা—কোনোটিই এসব শ্রমিকের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাঁরা হতদরিদ্র, নিরক্ষর এবং তাঁদের জীবন অনিশ্চিত। নির্বাচন, পরিবর্তন, উন্নয়ন—এসব সম্পর্কে তাঁদের আগ্রহ শূন্য, তাঁরা এখনো বাঁচেন দিন এনে দিন খাওয়ার আশায়।

পঞ্চগড়ের চা চাষ শুরুর নেপথ্যে ছিলেন বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাই। কাজেই, এত নিরাশায়ও তাঁর কাছে এ অঞ্চলের শ্রমিকদের আশা প্রখর। টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসা নবাগত এ সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক। দীর্ঘদিন ধরে ধকল পোহানো অর্থনীতির মেরুদণ্ড শক্ত করতে হলে উদীয়মান শিল্পকে যেমন অগ্রাধিকার দিতে হবে, তেমনই শিল্পশ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নেরও কোনোও বিকল্প নেই। উত্তরবঙ্গের দারিদ্র্য ঘোচাতে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের প্রয়োজন নেই।

আমাদের কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলে কৃষক ও শ্রমিক ভালো থাকলেই ভালো থাকবে গোটা দেশ।

প্রায় তিন দশক পর দেশের অর্থনীতির ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরার দায়িত্ব পেয়েছেন উত্তরবঙ্গেরই সন্তান আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সমতলের পাথরশ্রমিক ও চা-শ্রমিকদের জন্য তিনি কি করছেন, সেটিই এখন দেখার। তাঁর কাছে অনুরোধ, দয়া করে পঞ্চগড়ের এই পাথরশ্রমিকদের ওপর নজর দিন, সমতলের চা-শ্রমিকের জন্য কিছু করুন। সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত পরিকল্পনায় এই শিল্প দুটি অনেক দূর এগোতে পারে, ধরতে পারে অর্থনীতির হাল, যদি এ শিল্পের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন করা যায়।

ভোট আসে ভোট যায়, চান মিয়াদের ভাগ্য বদলায় না। দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রতিনিধিদের কাছে না পাওয়ার যে যাতনা বয়ে বেড়ান তাঁরা, সে যাতনা এবার অন্তত ঘুচুক। নির্বাচন, রাজনীতি, নেতৃত্বের ওপর যে অভিমান-উদাসীনতা তৈরি হয়েছে এই শ্রমিকদের, তা-ও দূর হোক। যত দ্রুত আমরা বুঝে উঠতে পারি, কৃষক-শ্রমিককে কষ্টে রেখে, উন্নয়ন-পরিকল্পনা থেকে তাঁদের বাদ দিয়ে এ দেশ ভালো থাকতে পারবে না, ততই আমাদের মঙ্গল, বাংলাদেশের মঙ্গল।

  • লেখক: শাফায়াত স্বচ্ছ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়