সিলেটে ট্রেনযাত্রা

আজকের সকালটা বেশ অন্য রকম। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু ভোরের কুয়াশায় মোড়ানো বাতাসে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। ফজরের নামাজ শেষে যখন স্টেশনে পৌঁছালাম, ট্রেনের হুইসেল কানে বাজল, ‘চল, সময় হয়েছে পথচলার।’ গন্তব্য সিলেট।

চাঁদপুর থেকে সিলেটের ট্রেনযাত্রা দীর্ঘ, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্ত যেন আনন্দের আবরণে মোড়ানো। জানালার ওপাশে ছুটে চলা মাঠ, নদী, গ্রামের মেঠো পথ, শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে, গরু চরাচ্ছে কৃষক—এসব চিরচেনা দৃশ্যগুলো এক অদ্ভুত শান্তি এনে দেয় মনে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টির গন্ধে ভিজে ওঠে বাতাস, ট্রেনের হুইসেলের সঙ্গে মিশে যায় পাখির ওড়াউড়ি।

রাত নামতেই পৌঁছে গেলাম সিলেট শহরে। শহরের আলো তখন ঝলমলে, কিন্তু চোখে ক্লান্তি। হোটেলে ঢুকে জানালা খুলে বাইরে তাকাতেই ভেসে এল চায়ের পাতার সুবাস। মনে হলো, ‘এই শহরের বাতাসেও যেন চা মিশে আছে।’ ক্লান্ত শরীর বিছানায় পড়লেও মনে ছিল একটাই ভাবনা, সকালেই দেখা হবে সিলেটের আত্মা, ইতিহাস আর চায়ের সুবাসে ভরা জীবনযাপন।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

‎ফজরের নামাজ শেষে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে মেখে বেরিয়ে পড়লাম শাহি ঈদগাহের পথে। শতাব্দীপ্রাচীন এই ঈদগাহ মাঠ শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, বরং সিলেটের ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। শত শত বছর ধরে এখানে লাখো মানুষ একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করে আসছে। ‎আজ সেই মাঠ নিস্তব্ধ। বাতাসে পাখির কিচিরমিচির, গাছের পাতায় শিশিরের ঝিলিক। মাঠের পাশের পুরোনো বটগাছের নিচে বসে মনে হচ্ছিল, এই মাটিতে কত প্রজন্ম নামাজ পড়েছে, দোয়া করেছে, আবার ফিরে গেছে আপন জীবনে। সময় বদলেছে, কিন্তু এই ঈদগাহ আজও অটুট এক ঐতিহ্যের সাক্ষী।

‎‎সকালের নাশতা শেষে যাত্রা শুরু হলো লাক্কাতুরা চা–বাগানের পথে। সিলেট বিমানবন্দর সড়কের পাশে বিস্তৃত এই বাগান যেন সবুজের এক মহাসমুদ্র। উঁচু-নিচু টিলায় সারি সারি চা–গাছ, মাঝে সরু রাস্তা, আর দূর থেকে ভেসে আসছে শ্রমিকদের হাসির শব্দ। ‎সূর্যের আলো পাতার ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে। এক পাশে কয়েকজন নারী শ্রমিক মাথায় ঝুড়ি তুলে চা–পাতা তুলছে। কাছে গিয়ে কথা হলো এক তরুণী শ্রমিকের সঙ্গে। তিনি মিষ্টি হেসে বললেন, ‘চা–বাগানের সৌন্দর্যের পূর্ণতা পেয়েছে আপনার চোখমুখের জীবন্ত হাসিতে।’ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবলাম, এই চায়ের স্বাদ, ঘ্রাণ আনন্দ দেয় না, এটি কঠোর শ্রমের প্রতীক।

‎বিকেলে চলে এলাম হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারে। সব মিলিয়ে এক মরমি পরিবেশ।

‎পরদিন সকালে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলাম টিলাগড় ইকোপার্কের পথে। শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পার্ক ২০০৬ সালে বন বিভাগ গড়ে তুলেছিল প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য। প্রবেশদ্বারেই চোখে পড়ল সারি সারি গাছ, টিলার ঢালু পথ, পাখির ডাক—প্রথম দেখায় মনে হলো এ যেন সবুজের ছোট্ট রাজ্য। ‎কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতেই কিছুটা হতাশা। অনেক জায়গা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। ঝোপঝাড়ে ভরে গেছে হাঁটার পথ, আর অনেক বেঞ্চ ভাঙা। কয়েকজন স্থানীয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগে এখানে অনেক মানুষ আসত, এখন নিরাপত্তার অভাবে অনেকেই এড়িয়ে চলেন। সন্ধ্যার পর তো একদমই ফাঁকা। মনে হলো, প্রত্যাশা ও বাস্তবতা কখনো এক হয় না, তবু প্রকৃতির টানে মানুষ আবার ফিরে আসে।

‎*লেখক: ‎শিক্ষার্থী, দাসাদী কামিল মাদ্রাসা, চাঁদপুর