‘সিনেমার পোস্টার দেখে আমরা তখন কুংফুতে মাতোয়ারা’

ব্রুস লির সিনেমার পাঁর ভক্ত ছিলেন সে সময়ের কিশোরেরা
ছবি: সংগৃহীত

আমরা দুর্বার ক্রীড়া চক্রের সদস্যরা গোপনে গোপনে সিদ্ধান্ত নিলাম ব্রুসলির মতো লম্বা চুল রাখব আর কুংফুর ড্রেস বানাব। এর মধ্যে একজন খবর দিল, আজিমপুর ৩৯ নম্বরের সেলিম ভাই ব্ল্যাকবেল্ট হোল্ডার। ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে বিকেলে জুডোর ক্লাস নেন। তাঁর সঙ্গে আছেন বিখ্যাত জুডোকা আওলাদ ওস্তাদ। তিনি ১৯৬৮ সালে প্রথম বাঙালি ব্ল্যাকবেল্ট হোল্ডার।
‘দুইটা আঙ্গুল দিয়া চোখে গুঁতা দেয়া যায়, জানো?’ বন্ধু সুমন বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এর ব্যাখ্যা দিল। বলাকা সিনেমা হলের বিলবোর্ডে ব্রুসলির ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ সিনেমার পোস্টার দেখে আমরা তখন কুংফুতে মাতোয়ারা। আর কত ফুটবল, ক্রিকেট খেলব? আত্মরক্ষা বলে একটা ব্যাপার আছে না!

খোকা-খুকু, বাচ্চা-কাচ্চাসহ কিশোর-যুবক সব বয়সী ছেলে-ছোকড়ারা হঠাৎ অল্পদিনেই কুংফু-জুডোর মাস্টার ব্রুসলির ভক্ত হয়ে গেছে। মাঠের একপাশে ফুটবল পড়ে থাকে। আমরা বিলবোর্ড আর লালবাগ মোড়ের চোরাই ভিসিয়ারের পোস্টার দেখে কুংফু রপ্ত করা শুরু করে দিয়েছি। হা...হু...শব্দ তুলে হাত–পা ঝাড়া দিয়ে বেশ কয়দিন নিজেরা নিজেরা অনুশীলন করেছি। এর মধ্যে ফ্লাইং কিক কীভাবে দিতে হয়, সেটারও মহড়া দিয়েছি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের বালুর ওপর। এখানে বেশি সুবিধা করতে পারি নাই কেয়ারটেকার চাচার জন্য। আমাদের দেখলেই বলেন, ‘আউলাউ ক্যা?’
রাহাত-সুমন হাতে–কলমে দেখিয়ে দিল, শত্রুপক্ষের চোখে দুই আঙুল দিয়ে কীভাবে গুঁতা দেওয়া যায়। ইমন বেশ চিন্তার সুরে বলল, ‘কিন্তু কেউ যদি আমাদের চোখে গুঁতা দেয়, বাঁচব কীভাবে?’ ‘এটারও ব্যবস্থা আছে।’ রাহাত দেখিয়ে দিল হাতের কবজি নাক–বরাবর সোজা রাখলেই আঙুল আটকে যাবে। আপাতত এই অনুশীলনটাই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।

সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকে ড্রয়িং রুমের কোনায় হালকা নীল কাপড়ের কাভার দেওয়া খয়েরি লেদারের সুটকেস দেখেই ইমন বরফের মতো জমে গেল। আমার হাত মাথার বড় বড় চুলে চলে গেল। অত্যন্ত পরিপাটি, খুব ভদ্র গোছের ছোট ফুফাকে দেখে টুক করে সালাম করে ইমন পালিয়ে যাচ্ছিল। ছোট ফুফা ইমনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাবু, কেমন আছো?’ আমাকেও ডেকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করে বললেন, ‘বাব্বা, কত বড় হয়ে গেছো!’
ছোট ফুফা অধ্যাপক আবদুস সাহিদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের ইতিহাসের জনপ্রিয় শিক্ষক। কয় দিন আগে ছিলেন গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। উনি নিউমার্কেট আর বাংলাবাজারের মল্লিক ব্রাদার্সে উনার লেখা ‘আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস’ এবং অন্যান্য বইয়ের প্রকাশনা এবং রয়ালিটি–সংক্রান্ত কাজে মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসেন। খুব মার্জিত, সুদর্শন, সুবেশধারী এবং ছাত্রমহলে খুব জনপ্রিয় শিক্ষক ছোট ফুফা ঢাকায় এলেই আমাদের চুল আর নখের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকান। সকাল হতেই আমাদের দুই ভাইকে বগলদাবা করে আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের পাশের সেলুনে নিয়ে বাটিছাটের ব্যবস্থা করে দেন। অনেক গাঁইগুঁই করেও ব্রুসলিকাট চুলটাকে রক্ষা করতে পারলাম না। চুল কাটার ক্ষতিপূরণ বাবদ সাগর-সম্ভারের চানাচুর, দুই পদের নারকেলি বিস্কুট আর পকেটভর্তি লজেন্সসহ হালকা দুঃখ হালকা আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরি।

পরদিন সন্ধ্যায় নিউমার্কেটের বেকার চত্বরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের মল্লিক ব্রাদার্সে ছোট ফুফার সঙ্গে পা রাখি। ঢাকা ভার্সিটি, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ আর হোম ইকোনমিকসের ভাইয়া—আপারা নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোর সামনের ফাঁকা চত্বরে সন্ধ্যায় গল্পগুজব করতে আসেন। মল্লিক ব্রাদার্সের ঝকমকে আলোয় ভরা বইয়ের দোকানের দামি দামি চকচকে গ্লসি পেপারের বইপত্র দেখে চোখে ধাঁধাঁ লাগে। ছোট ফুফাকে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘ভালো করে পড়াশোনা করলে তোমরাও এ রকম বই লিখতে পারবে।’
ছুটিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বেড়াতে এসে পর পর কয় দিন সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ইমন কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায়। আম্মার চোখেও ব্যাপারটা ধরা পড়ে। বকুল ভাইকে এ জন্য তদন্তের নির্দেশ দেন। বকুল ভাইয়ের ডাইরেক্ট অ্যাকশন। ইমনের পিছু পিছু ছোট ফুফুর কালাইশ্রীপাড়ার বাসায় হাজির। বাড়ির পেছনের পুকুরের পাড়ে ইমনের শার্ট-প্যান্ট দেখতে পেয়ে বকুল ভাই অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান হলেন।

আবার এর মধ্যে দুদিন আম্মার সঙ্গে অফিশিয়াল ভিজিটে বিকেলে ফুফুর বাসায় বেরিয়েও গেছে। এর মধ্যে গত কয় দিন জামি আমাদের দুজনকে নিয়ে পাশের ঘরের খাটের দিকে নিয়ে যায়। বলে, ‘সাত ব্যাডারে শোয়াইয়া রাখছি, দেখবা?’ ভয়ে আমি দৌড়ে আম্মার কাছে চলে যাই। এই বয়সেই খুন-খারাবি! জামি বারবার ইশারা করে আমাকে ডাকতে থাকে। ছোট ফুফা রুমীকে দেখতে পেয়ে বলেন, ‘বাবা, যাওতো মাতৃভান্ডারের মোদকের কাছে গিয়ে টাটকা গরম রসগোল্লা নিয়া আসো।’ ছোট ফুফার এসব বিষয় ব্র্যান্ড। প্রতিবারই রুমী বা জামিকে দিয়ে মাটির হাঁড়িতে করে বিখ্যাত মাতৃভান্ডার মিষ্টান্নভান্ডার থেকে গরম গরম রসগোল্লা এনে আমাদের খাওয়াবেনই। ছোট ফুফুর কাছে ‘সাত ব্যাডা’র ব্যাখ্যা পেলাম। খাটের নিচের সাতটি কাঁঠাল থেকে আমাকে আর ইমনকে আলাদা আলাদাভাবে দুটি কাঁঠাল জামি উপহার দিল।
জামির বিছানার পাশে বসে কথাগুলো মনে আছে কি না জানতে চাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের দুইবারের সাধারণ সম্পাদক এবং দুইবারের সভাপতি প্রখ্যাত সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন জামি হো হো করে হেসে বলল, ‘এত কিছু আপনার মনে আছে?’ চিকিৎসার জন্য আবার ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে যাবে। আমার হাত ধরে বলল, ‘সুমন ভাই, আমার সঙ্গে একটু ভাত খান। আমার ভালো লাগবে।’ খেতে খেতে মৃদুভাষী, ছোট ফুফার মতোই ধীরস্থির এবং ভদ্র জামি বলল, ‘সুমন ভাই, আমাকে আব্বার কথা আরেকটু বলেন।’ মাত্র ৯ বছর বয়সে এতিম হয়ে যাওয়া জামির পিঠে হাত বুলিয়ে চোখের পানি সামলাতে পারলাম না।

বি:দ্র: রিয়াজউদ্দিন জামি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ৬ মার্চ ভারতের টাটা মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন

আসফাক বীন রহমান: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।