কুয়াশার মায়াবী চাদরে আবৃত নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় ফুটে উঠেছিল প্রকৃতির মায়ার রহস্য। কবি লিখেছেন, ‘ধরণী দিয়াছে তার গাঢ় বেদনার, রাঙা মাটি–রাঙা ম্লান ধূসর আঁচলখানি, দিগন্তের কোলে কোলে টানি, পাখি উড়ে যায় যেন কোন মেঘ-লোক হতে, সন্ধ্যা-দীপ-জ্বালা গৃহ-পানে ঘর-ডাকা পথে।’
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণেও যেন সেই ধূসর নীরবতার প্রতিধ্বনি শোনা যায়, খুব ভোরে যখন চারপাশ আবৃত হয় কুয়াশার মায়াবী চাদরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় যেন এক অপূর্ব কাব্যের দিকে যাত্রা করছি। কাঁচা ঘাসের ওপর সাদা কুয়াশা ছড়িয়ে পড়লে এক অসাধারণ নান্দনিকতা তৈরি হয়। সেই রাস্তা ধরে একটু এগোলেই কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, যেখানে শীতের প্রথম কুয়াশায় ভিজে থাকা সবুজ ঘাসের ওপর সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মি পড়লে মনে হয়, যেন প্রকৃতির বিশাল ক্যানভাসে চিত্রিত হয়েছে এক নতুন দৃশ্য। মাঠের আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য বেড়ে উঠতে থাকা বৃক্ষগুলো ঠান্ডা হাওয়ায় দুলতে দুলতে যেন নিজেদের সংগীত রচনা করে। সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা কবি নজরুলের ভাস্কর্যটিকে ঘিরে রাখে সদ্য ঝরে পড়া শুভ্র শিউলি ফুল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ও বিজ্ঞান ভবনের সম্মুখ পথ ধরে হেঁটে গেলে মনে হয় সেই চিরন্তন গানের সুরে গাহি সাম্যের গান মঞ্চের দিকে চলেছি। কাজী নজরুলের সাম্যের চেতনা এই মঞ্চে যেন প্রতিফলিত হয় শিক্ষার্থীদের উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে। যখন সেখানে কুয়াশার চাদরে আবৃত হয়ে আসতে থাকে, তখন মনে হয় যেন একেকটি নতুন দিনের সন্ধানে তারা ছুটে এসেছে। এই মাঠ, এই মঞ্চ, সব যেন তাদের চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রান্তে জয়ধ্বনি মঞ্চ যেন একটি ছোট পৃথিবী। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয়, কুয়াশা ও শীতের মায়ায় ঘেরা সেই মঞ্চে কাজী নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার আবহে এক আধ্যাত্মিক অনুভূতির জন্ম হয়। কবির বিদ্রোহ, প্রেম ও সাম্যের আহ্বান যেন এই শীতের প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে শিক্ষার্থীদের মনে দোলা দিয়ে যায়। তাদের চোখে কাজী নজরুলের বাণী যেন নতুন অর্থে প্রকাশ পায়।
মাঠের পূর্বে দাঁড়িয়ে যখন দেখি সূর্য অস্ত যাচ্ছে, পশ্চিম আকাশ রক্তিম আলোয় রাঙিয়ে তুলছে, তখন শিক্ষার্থীদের মনে নতুন স্বপ্নের অঙ্কুরোদ্গম হয়। যেন কবির কৈশোরের প্রভাবেই এই প্রাঙ্গণ তাঁর ইতিহাসের ধারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শীতের এই ঠান্ডা বিকেল তাদের প্রতিটি চিন্তাকে আরও গভীর করে দেয়। শুকনি বিলের পাশে গড়ে ওঠা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যারা হেঁটে যায়, সেই শীতল হাওয়ায় মনে পড়ে যায় নজরুলের কথা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে প্রবেশ করলে সবখানেই নজরুলের সাহিত্য আর শীতের ঋতুর এক নিখুঁত মিলন ঘটে। পড়ন্ত বিকেলের আলোর ছোঁয়ায়, শীতের মিষ্টি হাওয়ার মূর্ছনায় এবং কুয়াশার চাদরে মোড়া প্রতিটি স্থান যেন এক কবিতার অন্তরঙ্গ অংশ হয়ে ওঠে।
যেন নজরুল এই ক্যাম্পাসের বটতলায় বসেই গাইছেন, ‘সুন্দর দাঁড়ায়ে তব দ্বারে আঁধারে, মঞ্জরি-দীপ জ্বালো ডাকো তারে।’
লেখক: অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ, শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।