দুর্গাপূজা: ধ্বনিত হোক মঙ্গল কামনায়
স্নিগ্ধমুখর কণ্ঠে দূর থেকে ভেসে আসা চণ্ডীপাঠের সুমধুর সুর দুর্গাপূজার আগমনী বারতা প্রকাশ করে। কাশফুলের শুভ্রতা, শিশিরভেজা শিউলি ফুল আর বাতাসে বদলে যাওয়া ঘ্রাণ—সবই বার্তা দিচ্ছে শারদীয় উৎসব দুর্গাপূজার। তিথির ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয় বলে বছরের কোনো নির্দিষ্ট তারিখে দুর্গাপূজা হয় না। প্রতিবছর আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের তিথিতে শুরু হয় দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজা শুধু ব্যাপ্তিতে নয়, বৈচিত্র্যেও অনেক বিস্তৃত। যুগ যুগ ধরে আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবী দুর্গার আরাধনা করে আসছি। মূলত মানবসভ্যতায় ঈশ্বরবিশ্বাসীদের জন্য এই দেবীরূপের প্রকাশ অনেক প্রাচীন। সর্বপ্রাচীন যে গ্রন্থে দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা হলো ঋকবেদ।
পরম ব্রহ্মের প্রকাশক্ষমতা জীব আত্মারূপে ধারণ করে। সাকার ও নিরাকার উভয় রূপের মধ্যেই শক্তির অবস্থান। শক্তির এই উপলব্ধি শিল্পীর ভাবনা বা কল্পনা প্রতিভার সাহায্যে কোনো বস্তু (পাথর, কাঠ, মাটি, ধাতু) রূপলাভের প্রতীক বা প্রতিমা হিসেবে বিবেচিত হয়। সে কারণেই আমরা দেবীকে সাকার আরাধনা করি। মন্ত্রের মধ্যে যে প্রতীকী ব্যঞ্জনা, যে চিত্রকল্প, তা-ই প্রতিমারূপে বিনির্মিত।
পূজার আগমনী বার্তা জগৎসংসারের সব দুঃখ ও গ্লানি মুছে দিয়ে মানবমনে ধ্বনিত হয় মঙ্গল কামনায়। মঙ্গল হিতার্থে ব্রতী থেকেই প্রতিবছর পূজার মাধ্যমে শুরু হয় দেবীর আরাধনা। তাই ব্যক্তিগত পূজার পাশাপাশি সর্বজনীন পূজারও আয়োজন করা হয়। প্রতিবছরের মতো এ বছরও দুর্গাপূজা তার বৈভব ও বিভূতি নিয়ে আমাদের দ্বারে আগত। দেবীর একই অঙ্গে বহুরূপ। যিনি দুর্গা তিনি কালী, আবার তিনিই জগদ্ধাত্রী, তিনিই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী। কখনো তিনি দশভুজা আবার কখনো তিনি অষ্টভুজা। ভাগবত অনুসারে, দেবীর অষ্টভুজা রূপই যোগমায়া।
শাস্ত্রে শ্রীশ্রী দুর্গা দেবীর অনেক নামের মধ্যে মহাশক্তি, ব্রহ্মময়ী, আদ্যাশক্তি, নারায়ণী, চণ্ডী, মহিষমর্দিনী, অসুরনাশিনী এসব নাম বিশেষভাবে পরিচিত। এই নামগুলোর প্রতিটি অর্থের মধ্যে একটি দর্শন, একটি অন্তর্নিহিত তত্ত্ব এবং মাহাত্ম্য রয়েছে। পৌরাণিক মতে, বিশ্বের সব শক্তির মিলিত রূপ হলেন দেবী দুর্গা। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বলা হয়েছে, তিনি আদ্যাশক্তি ও সনাতনী। ব্রহ্মারূপে তিনি সৃষ্টি করেন, বৈষ্ণবী শক্তিরূপে পালন করেন। শিবানীরূপে বস্তুর পরিণতি বিধান করে মঙ্গল সাধন করেন। ‘মা দুর্গা’ নামটি মঙ্গলদায়িনী শক্তি হিসেবে আমাদের মননে গেঁথে রয়েছে।
শাস্ত্র অনুসারে, ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমর্তাঃ।’ অর্থাৎ যিনি সব দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি, তিনিই দুর্গা। তিনি ‘ত্রম্বকে’ অর্থাৎ ত্রিনয়না। দেবীর বাঁ চক্ষু হলো ইচ্ছা এবং চন্দ্র হতে উৎপত্তি। তাঁর ডান চক্ষুটি কার্য এবং সূর্যের প্রতিভু। দেবীর কপালের নয়ন হলো জ্ঞান ও অগ্নির প্রতিভু। দেবী দুর্গার বাহন সিংহ, যা অহংবোধকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিনিধিত্ব করে দৃঢ় সংকল্পের। যখনই জগতে অসুর রিপুধারীদের অত্যাচারে সৃষ্টি অত্যাচারিত হয়, তখনই ভগবান নানা সময়ে নানারূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। নানারূপে অবতীর্ণ হয়ে আপন সৃষ্টিকে রক্ষা করেছেন। সে জন্য অসুরকে বিনাশ করে আসুরিক শক্তিকে ধ্বংস করেছেন।
তবে একেক রূপের একেক মাহাত্ম্য নিয়ে দেবীর আগমন ঘটে। মহাভারতের যুদ্ধ থেকে মহিষাসুর–বধ পর্যন্ত তিনি বিরাজমান। সব স্থানে মাতৃরূপে পূজিত হন বিশ্বজনীন মা দুর্গা। এ শান্ত-স্নিগ্ধ মাতৃরূপের পায়ের কাছে পড়ে থাকে রক্তের রেখা। মা দুর্গা ‘ত্রিশূলধারিণী’। মহিষের দেহ ফুঁড়ে মহিষাসুরের বুকে বিঁধে থাকে ত্রিশূলের ফলা। এ ত্রিশূল তাঁকে দিয়েছিলেন স্বয়ং শূলপাণি শিব। শাস্ত্রে ত্রিশূলের বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। কখনো তিনটি গুণ সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ গুণ প্রকাশ করে। কখনো সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থে ত্রিশূলকে জাগতিক মায়া থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ব্রহ্মময়ী মা দুর্গা হলেন ব্রহ্মগুণের প্রতীক, যা শুদ্ধ সত্ত্বগুণময়ী। পশুরাজ সিংহ রজোগুণের প্রতীক এবং অসুররাজ হলেন তমোগুণের প্রতীক। ব্রহ্মময়ী মা রজোগুণের সাহায্যে তমোগুণকে বিনাশ করেন। এ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে, সব দেহধারী জীবাত্মা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই তিন গুণের অধিকারী। সত্ত্বগুণ নির্মল জ্ঞানের অধিকারী হয়। রজোগুণের ফলে লোভ জন্মে। তমোগুণ ভ্রান্তি ও অজ্ঞানতাহেতু উৎপন্ন হয়। তমোগুণের ফলে বুদ্ধিনাশ হয়, বুদ্ধিনাশ হলে বিনাশ ঘটে। তাই পূজায় মায়ের নিকট চাওয়া থাকে যেন সবার মধ্যে ব্রহ্মগুণ বা সত্ত্বগুণ উদয় হয়ে জগৎসংসার কল্যাণময় হয়। যেন রজোগুণকে ব্রহ্মগুণ দ্বারা নিবৃত্তি করতে পারে, আর নিজের মধ্যে স্থিত তমোগুণকে নাশ করতে পারে। একজন মানুষ ব্রহ্মগুণী হলে ধর্ম ও মোক্ষের ডোরে অর্থ ও কামকে বাঁধতে শিখবে। তখনই ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ে স্থিত হবে। এরূপ মনের অবস্থা হলেই কেবল জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগের উপলব্ধি আসবে।
এ পূজার সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের সম্পর্ক অপরিসীম। শ্রীরামচন্দ্র জ্ঞানযোগ সাধনার পথপ্রদর্শক, শ্রীলক্ষ্মণ ভক্তিযোগের, রাজা ভরত কর্মযোগের ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা শত্রুঘ্নœরাজযোগের প্রতীক। তাঁরা একে চার ও চারে এক। এ চারটি যোগের সাধনা সাধককে চারটি বেদের কাছে নিয়ে আসে। ঋকবেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ। তাই দুর্গাপূজা হলো মাতৃ–আরাধনা ও সাধনা। শুধু উৎসবে সীমাবদ্ধ নয়, চির–আনন্দলোকের যাত্রী আমাদের সবার আনন্দময়ী মা।
দেবীর হাতে থাকা প্রজ্বলিত অগ্নি একদিকে যেমন অস্ত্র, তেমনি দেবীর নিজস্ব শক্তিও প্রকাশ পায়। শাস্ত্রমতে, অগ্নি যাবতীয় ক্লেদ থেকে জগৎকে পরিশুদ্ধ করে রাখে। তাই মনের আসুরিক শক্তি বিনাশ করে বলীয়ান হতে সবাই প্রার্থনায় মিলিত হয়ে বলি:
ওঁ অসতো মা সদগময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মামৃতং গময়। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)
আবিরাবীর্ম এধি। (ঐতিরেয় উপনিষদ)
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং, তেন মাং পাহি নিত্যম।
অর্থাৎ অসত্য থেকে আমাকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আমাকে জ্যোতিতে/ আলোতে নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে আমাকে অমৃতে নিয়ে যাও। হে স্বপ্রকাশ; আমার নিকটে প্রকাশিত হও। রুদ্র্র, তোমার যে প্রসন্ন মুখ, তার দ্বারা আমাকে সর্বদা রক্ষা করো।
সব আসুরিক শক্তিকে ধ্বংস করে বিশ্বসংসার জাগরিত হয়ে উঠুক মহামায়ার মঙ্গলময় বারতায়। তাই আমাদের করজোড়ে নিবেদন—
প্রভু, বিশ্ব-বিপদহন্তা, তুমি দাঁড়াও, রুধিয়া পন্থা।
তব, শ্রীচরণ তলে নিয়ে এস, মোর মত্ত-বাসনা ঘুচায়ে!
লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা