এ দেশের বুকে নেমে আসুন দেবী নেমেসিস
নেমেসিস—গ্রিক মিথোলজির এক রহস্যময় দেবী। তিনি প্রাচীন গ্রিক নাগরিকদের কাছে কিংবদন্তিতুল্য হয়ে উঠেছিলেন সৃষ্টিকর্তা কিংবা ঐশী প্রতিশোধের আত্মা হিসেবে। গ্রিক ট্র্যাজেডি কিংবা হেলেনীয় বোধে (সফোক্লিস, হোমার, আসিল্যাস, ইউরিপিদাস প্রমুখ) মহাকাব্যগুলোর মৌলিক ভাবনা দেবী নেমেসিসকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল। এমনকি আধুনিক যুগের শেক্সপিয়ার, দস্তয়েভস্কির সাহিত্যের উপসংহার নেমেসিসসীয় চেতনা বা সৃষ্টিকর্তার প্রতিশোধ কিংবা অমোঘ নিয়তি।
বাংলা সাহিত্যও কম যায়নি। নুরুল মোমেন বাংলা সাহিত্যে ‘নেমেসিস’ নামের সার্থক এক নাটক রচনা করেছিলেন। যেখানে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ যা ‘তেতাল্লিশের মন্বন্তর’ নামে সমধিক পরিচিত; সেখানে তখনকার সময়কার অসাধু মজুতদার, আড়তদার, চোরাকারবারিদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার দৃশ্য চিত্রায়িত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন নাটকের মূল চরিত্র সুরজিত নন্দী; যিনি পেশায় স্কুলশিক্ষক কীভাবে মানুষের জীবনে দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন, অন্যায়-অনিষ্ট কায়েম করে নিজের জীবনের অনিষ্ট ডেকে আনেন, তা-ই ফুটিয়ে তুলেছেন।
নুরুল মোমেনের নেমেসিসের বিষয়বস্তু এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থনীতি যেন একই বৃন্তের দুটি ফুল। একদিকে অন্নের জ্বালা; অন্যদিকে আড়তদার, মজুতদার, জোচ্চোর, সুদখোর, দুর্নীতিবাজ, সুবিধাবাদী। ঠিক যেমন নুরুল মোমেন বলেছিলেন, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার বাংলাদেশ আজ নিরন্ন! আমাদের নালিশ আজ বাংলাদেশের লোকের বিরুদ্ধে, যারা দেশবাসীর উদ্যত হাঁর সম্মুখ থেকে অন্ন সরিয়ে নিচ্ছে চার গুণ লাভের আশায়। অনাহার আর ক্ষুধায় দেশটাকে পিষ্ট করেছে। মায়ের দুধে স্তন নেই। চুষে চুষে দুধ না পেয়ে সন্তানগুলো কুকুরছানার মতো কুই কুই করছে মায়ের বুকে।’
শোষণ, বঞ্চনার আর লাঞ্চনার বিরুদ্ধের মূলমন্ত্র নিয়ে যে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, স্বাধীনতার পর সে দেশের সাধারণ মানুষ গুটিকয় বুর্জোয়া ও তাদের তাঁবেদারদের হাতে জিম্মি।
নেমেসিসের মূল চরিত্র সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত দরিদ্র স্কুলশিক্ষক সুরজিত নন্দী শুরুতে ন্যায়নিষ্ঠা ও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু জোতদার নৃপেন বোসের কন্যা ‘সুলতা’কে ভালোবেসে বিয়ে করে সমাজ-স্বীকৃতির জন্য নিজের বিবেক বিসর্জন দিতে শুরু করেন। ধনী নৃপেন তাঁর মেয়ের জামাইয়ের স্বীকৃতি নিতে তাঁকে শর্ত জুড়ে দেন। শর্তটি ছিল সুরজিতকে তিন মাসের মধ্যে লাখ টাকার মালিক হতে হবে; নতুবা তাঁদের বিয়েকে তিন স্বীকৃতি দেবেন না। অবশ্য জামাইকে ধনী হওয়ার মজার খেলা শেখাতে লোভী নৃপেন অস্বীকৃত জামাইকে পয়সা কামানোর রাস্তা দেখাতে কার্পণ্য করেননি। সুরজিত নিজের আত্মশিক্ষা, আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে খাদ্যপণ্য কালোবাজারির পথ বেছে নেন সুরজিত। যেখানে লাখো নিরন্ন মুখ একটু খাবারের আশায় কাতরাতে থাকে, সুরজিত তখন অধিক লোভের আশায় খাদ্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তাদের মৃত্যুযাত্রা আর সহজ করে দেন।
নাট্যকারের ভাষায়, ‘বর্ণচোরার দেশে নিজ স্বার্থের জন্য বিবেকটাকে সাপের খোলসের মতো ত্যাগ করা নতুন কোনো বিষয় না।’ যা আমাদের দেশের বর্তমান পটভূমিতে দারুণভাবে খাটে। একবিংশ শতাব্দীতে বিবেক বর্জনের এক অশুভ শক্তি ভর করেছে এই বর্ণচোরার দেশে। নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে বৈধ-অবৈধ ধনসম্পত্তি আহরণের এক প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে এ দেশের সব স্তরের জনগণ। একদিকে একদল মানুষ মজুতদারি, কালোবাজারি, দুর্নীতি, লুটতরাজ, খুন, রাহাজানি করে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, বিলাসী জীবনযাপন করছেন, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতির পদতলে পিষ্ট হয়ে আরেক দল অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। এ দেশের আমলা, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ব্যবসায়ী এমনকি সরকারি অফিসের কেরানি পর্যন্ত দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। উদাহরণস্বরূপ সম্প্রতি পুলিশের শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, কর কর্মকর্তা মতিউর রহমান, বন সংরক্ষক মোশাররফ হোসেন, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার, সাবেক সাংসদ বদি, এস আলম গ্রুপ, কিংবা গাড়িচালক আবেদ আলীরা নজীরবিহীন দুর্নীতি, অর্থ কেলেঙ্কারি, মাদক ব্যবসা ও সোনা চোরাচালান কিংবা পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস কেলেঙ্কারি এ দেশের উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এ রকম অরাজকতা, অনিয়মের কারণ দর্শাতে অনেকেই এ দেশের ঘুণে ধরা রাষ্ট্রব্যবস্থা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক অবস্থাকে দোষারোপ করছেন। কিন্তু আমি তার সঙ্গে যোগ করি আমাদের মনন-মগজের পচন ধরাকে। যেখানে মেধার থেকে স্বজনপ্রীতি বেশি, যোগ্যতার থেকে চাটুকারিতার মূল্যায়ন বেশি সেই সমাজে কখনো সচলাবস্থা ও সঠিক পথে থাকতে পারে না। নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হতে থাকে।
আরেক কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি আমাদের পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার।
ছোটবেলায় আমাদের মুখের বুলি না ফুটতেই আমাদের শেখানো হয় ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে’। আমাদের তালিম দেওয়া হয় অর্থ উপার্জনই শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য। আবার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কথা উল্লেখ করলে দেখা যারা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ কী তা শিক্ষাব্যবস্থা নিজেই জানে না!
যেখানে কড়ায়-গন্ডায় সুদকষা, দুধের সঙ্গে পানি মেশানোর অনুপাত শেখানো হয় কিন্তু মানবিকতা ঊহ্য থেকে যায়। শিক্ষা যেন আজ ব্যবসায় পরিণতি হয়েছে। প্রসঙ্গত, প্রতিবছরই নতুন নতুন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে সার্টিফিকেট বিক্রির জন্য। আবার সার্টিফিকেট কিনেও শিক্ষার্থীদের মুক্তি মেলে না। আবার আগে এ দেশে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণির চাকরির প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটলেও কয়েক দিন আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ মারফত জানলাম, অর্থের বিনিময়ে দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন কেনা যায়। এ দেশের শিক্ষার্থীরা যখন চাকরিতে কোটার কারণে চাকরির বাজারে খাবি খাচ্ছে, কোটার বিরোধিতা করে আন্দোলনে নেমেছেন, ঠিক তখন বিপিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর তাদের পশ্চাদ্দেশে বিষফোড়ার মতো যন্ত্রণা দিচ্ছে। যা ন্যায়নীতিবিরুদ্ধ, বৈষম্যের সৃষ্টি করছে এবং প্রকৃত মেধাবীদের বঞ্চিত করছে।
সর্বশেষ বলতে চাই, যারা বিবেক বর্জন করে লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে অন্যায়ে জড়িয়ে পড়ে, তাদের কোনো না কোনো দিন সেই বিবেকের দংশনেই দংশিত হতে হয়। ঠিক যেমন ‘নেমেসিস’ নাটকের সুরজিতের প্রাণনাশ হয়েছিল তারই এক কালোবাজারি বন্ধুর কাছে। যে ধনসম্পত্তির লোভে মানুষ ঠকিয়ে সে তার প্রিয়তমাকে আপন করতে চেয়েছিল, সেই ধনসম্পত্তিই একসময় তার প্রাণনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাস্তবিক দৃষ্টিতে সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত সংসদ সদস্য আনার হত্যাকাণ্ড কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁসের টাকায় পিএসসির গাড়ি চালক আবেদ আলীর জনপ্রতিনিধি হওয়ার শখ ভেস্তে যাওয়া যেন দেবী নেমেসিসের ন্যায়বিচারকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সবারই উচিত আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজের বিবেককে বিসর্জন না দেওয়া। ফলে রাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেরও সর্বনাশ ডেকে আনতে পারেন।
লেখক: সউদ আহমেদ খান, পরিবেশ ও জলবায়ুকর্মী