স্বচ্ছ শাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কার করতেই হবে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি।’ সত্যি এখনো আমরা পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ও মানবিক মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি। আমরা এখনো ভিন্নমতকে স্বাগত জানাতে পারি না, আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী মৌলিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে অনীহা প্রকাশ করি। আমরা সংখ্যালঘু মতামতের কোনো প্রতিফলন দেখতে চাই না। আমরা অন্যের সাফল্য দেখে ঈর্ষাকাতর হই এবং প্রশংসা করতে কার্পণ্যবোধ করি। আর সমালোচনা তো মনে হয় সহ্যই করতে পারি না। কিন্তু গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই হচ্ছে, সমালোচনাকারী বা সংখ্যালঘু বা ভিন্নমতাবলম্বীর মতামতকে সবার আগে গ্রহণ করতে পারার উদার মানসিকতা।
ইংরেজ রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক হ্যারল্ড জে লাস্কি বলেছেন, ‘একটা রাষ্ট্রের গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী, সেটা ওই রাষ্ট্রের বিচারবিভাগ কতটা স্বাধীনভাবে রায় দিতে পারে, তা দেখলেই বোঝা যায়।’ আর আমরা তো আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগের ইতিহাস জানি ও দেখেছি যে তাঁরা কতটা স্বাধীনভাবে রায় দিতে পারেন! আর স্বাধীনভাবে রায় দিলেও পরবর্তীতে কী ফলাফল হয় তা–ও দেখেছি (যেমনটা ঘটেছে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে, এখন দেশের বাইরে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন)। ছাত্র-অভ্যুত্থানের আগে ও পরে আমরা দেখতে পেয়েছি, বিচারবিভাগে কীভাবে রায় দিচ্ছেন। এভাবে বাংলাদেশের সব সরকারই বিচার বিভাগকে নিজের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার চেষ্টা ও ব্যবহার করেছেন।
ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের পরিপূর্ণ সফলতা উপভোগ করতে হলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর টেকসই সাংবিধানিক সংশোধনী বা পরিবর্তন জরুরি, যা আমি আমার ব্যক্তিগত মতামতে কিছু বিষয় তুলে ধরছি। যেমন আমাদের সংবিধানের ১৮টি মৌলিক অধিকারের সঙ্গে আরও দুইটি মৌলিক অধিকার যুক্ত করা প্রয়োজন। ক). সরকারের সব কার্যাবলির নির্ভয়ে সমালোচনা করার অধিকার ও খ). সরকারি কর্মচারীদের নির্বাহী বিভাগের কার্যাবলির গঠনমূলক সমালোচনা করার অধিকার। (এটা নিয়ে অনেকেরই দ্বিমত থাকতে পারে) তবে অন্য সব পেশাজীবী মানুষেরা যেভাবে সরকারের আলোচনা করেন বা সমালোচনা করতে পারেন, সরকারি কর্মচারীরা সব সময় মনে হয় বোবা হয়ে থাকেন। এর কারণ বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস (BSR) অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীরা সরকারের নীতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে পারেন না। আমাদের জাতীয় সংসদ হতে পারে দুই কক্ষবিশিষ্ট। নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ। নিম্নকক্ষে থাকবে ৩০০ আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা। আর উচ্চকক্ষের মোট সদস্য সংখ্যা হতে পারে ১২৮+২২=১৫০ জন। ১২৮ জন প্রত্যেক জেলা হতে দুইজন নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে আর বাকি ২২ জন রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ যেমন— কৃষক, শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, কূটনীতিক, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, অভিনেতা প্রমুখ ব্যক্তিদের (সংরক্ষিত হিসেবে) নিয়োগ দিতে পারেন। উভয় কক্ষের মেয়াদ হতে পারে চার বছর। তবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পদ্ধতি চালু করতে পারি যেমন— মধ্যবর্তী নির্বাচনব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, মানে উভয়কক্ষের নির্বাচন হবে দুই বছর আগে ও পরে। যেমন নিম্নকক্ষের নির্বাচন যদি ২০২৬ সালে হয়, তাহলে উচ্চকক্ষের নির্বাচন হবে ২০২৮ সালে। এভাবে পরবর্তীতে, নিম্নকক্ষের নির্বাচন হবে ২০৩০ সালে এবং উচ্চকক্ষের নির্বাচন হবে ২০৩২ সালে। যেকোনো বিল উভয় কক্ষে পাস করাতে হবে। তাই সরকার যদি কর্তৃত্বপরায়ণ হতে থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টের যেকোনো কক্ষে বা উভয়কক্ষে সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রুখে দিতে পারব। এর ফলে যেকোনো বিল পাস বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের একগুঁয়ে ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাব আমরা বন্ধ করতে পারব। সংবিধান সংশোধনী হওয়া প্রয়োজন পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের তিন চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থনের ভিত্তিতে। তাহলে সরকার এককভাবে দ্রুত হঠকারিতার বশে সহজে কোনো সংবিধান সংশোধনী আনতে পারবে না। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে কোরাম হওয়া দরকার ২০০ জনের (বর্তমানে জাতীয় সংসদে তা আছে ৬০ জনের)। তাহলে সংসদ সদস্যদের জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা আরও বাড়বে।
বিরোধী দলকে ছায়া সরকারের মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে এবং এই ছায়া সরকারের একটি ছায়া মন্ত্রীপরিষদ থাকবে, যারা সরকারি দলের মন্ত্রীদের সঙ্গে গঠনমূলক তর্কবিতর্ক করতে পারবে। তাহলে পার্লামেন্টের অধিবেশন আরও প্রাণবন্ত হবে এবং সরকারের জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা যাবে।
ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ দিতে হবে বিরোধী দল থেকে, তাহলে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকবে। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার বসার জায়গার মুখোমুখি দূরত্ব হতে পারে সর্বোচ্চ আট ফিট। ব্রিটেনের পার্লামেন্টের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ ক্ষেত্রে সংসদীয় নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতার বিতর্ক জমজমাট হয়ে উঠবে, তাতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যা দ্রুত স্বচ্ছতার সঙ্গে সমাধান হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে, ফলে জনগণ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আরও বেশি করে জানবে এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে পারবে। পার্লামেন্টের সংসদ সদস্যরা একাধারে ৩০ কর্মদিবসের বেশি অনুপস্থিত থাকতে পারবেন না (বর্তমান সংবিধানে আছে ৯০ কর্মদিবস)। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর চেয়ারপারসন বিরোধীদলীয় হতে পারে ৪০ শতাংশ। এর ফলে কোনো বিল বা আইন কীভাবে সর্বোচ্চ জনকল্যাণকর হতে পারে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। অনুচ্ছেদ ৭০ বাতিল করতে হবে এবং সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরাও যেন সরকারের বিভিন্ন বিল বা আইন বা সরকারের যেকোনো কার্যাবলীর নির্ভয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারেন বা প্রয়োজনে বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে (Floor crossing), এটি নিশ্চিত করতে হবে। সংসদ সদস্যদের মূল কাজ আইন প্রণয়ন করা। সংসদ সদস্যদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা হয়ে থাকা ও নিজ সংসদীয় এলাকায় ক্ষমতার অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে আইনি সংস্কার এখন সবার দাবি।
সংবিধান প্রণয়নের ৫২ বছর পরেও ন্যায়পাল নিয়োগ অধরাই থেকে গেল। তাই দ্রুত ন্যায়পাল নিয়োগ করা দরকার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান করে এর কাজের ক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দুদকের আইনগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করা দরকার যেন কোনো সরকার চাইলেও সেখানে অবৈধ হস্তক্ষেপ করতে না পারে। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পর্যন্ত সকল জনপ্রতিনিধি দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবে না এবং সব জনপ্রতিনিধির শিক্ষাগত যোগ্যতা হওয়া উচিত ন্যূনতম মাস্টার্স পাস এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে কোথাও তৃতীয় শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হবে না। গণভোটকে আবার ফেরত আনা দরকার। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা আছে কি না, বা কোনো জাতীয় বিষয়ে মতামত যাচাইয়ের জন্য প্রতি দুই বছর পরপর গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। যদি সরকারি দল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না পায়, তাহলে রাষ্ট্রপতি আস্থাহীনতার অভাবে সংসদ ভেঙে দিয়ে আবার নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে পারে। এর ফলে সরকার সহজে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচার মনোভাবী হতে পারবে না।
একটি অবাধ স্বচ্ছ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। আমরা দেখেছি সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচনে অনিয়ম হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। এর ফলে নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা ও ভরসা দুটোই বাড়বে এবং নির্ভয়ে জনগণ তার রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের নিয়োগ হতে পারে বিগত নির্বাচনের প্রধান পাঁচটি রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের ছয়জন প্রতিনিধির সমন্বয় করা কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে। ফলে ওইসব পদের ব্যক্তিরা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে সর্বদা সচেষ্টা থাকবে।
আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিদের নিয়োগ হতে পারে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন থেকে। তাহলে বিচারকদের নিরপেক্ষতা ও সুচিন্তিত রায় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বয়স ৭৫ বছর বা আমৃত্যু করা যেতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচারকেরা আরও বেশি ঋদ্ধ হয় এবং গভীর বিবেচনাপ্রসূত উত্তম রায় দিতে পারে। বিচারবিভাগকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে মুক্ত করতে হবে এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির সম্পূর্ণ এখতিয়ার থাকবে বিচার বিভাগের।
বাংলাদেশ ব্যাংককে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে মুক্ত করতে হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কঠোর আইন প্রণয়ন করে পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীন মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে পারবে এবং মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় বাজেটের ৮-১০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বৈধ ছাত্র সংসদ থাকবে। কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করা রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ থেকে ৫৯ বছর পর্যন্ত। বাংলাদেশে ৪৫ বৎসর বা আরও বেশি করা যেতে পারে। দেশে আরও অনেক ক্ষেত্রে অনেক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, আমি তার মধ্যে অল্প কয়েকটা লিখলাম।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী এ সুসময়ে এ সংস্কারগুলোর সাংবিধানিক বৈধতার নিমিত্তে (সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে, নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশনে ৩০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বা নির্বাহী আদেশগুলো আইন আকারে পাস করতে হবে, অন্যথায় অধ্যাদেশটির কার্যকরতা লোপ পাবে) রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে সম্মতি আদায় করে নিয়ে রাষ্ট্রপতি দ্রুত প্রয়োজনীয় অধ্যাদেশগুলো জারি করে একটি অবাধ–সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে পারে, এটাই সকল দেশবাসীর প্রত্যাশা।
*লেখক: মো. মোস্তাফিজুর রহমান, প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ, ঠাকুরগাঁও। [email protected]
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]