নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আলাদা অধিদপ্তর প্রয়োজন
বর্তমানে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ। অবশ্য এ মর্যাদা ২০১৮ সালে পেয়েছি। ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। প্রধানমন্ত্রী এ লক্ষ্যে ১০০ বছর মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রীর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে এবং ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশের কাতারে থাকব ইনশা আল্লাহ। একটি কথা অন্তত জানা দরকার, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমরা উন্নত হলে সভ্যতার উন্নয়ন করাটাও জরুরি। সেই সঙ্গে উন্নয়নটাও টেকসই হওয়া দরকার। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে এবং উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে মানবসম্পদকে সুদক্ষ, মার্জিত ও সভ্য করে গড়ে তুলতে হবে। অবশ্য এ কাজে সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে ২০৪১ সালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন এবং ২০২৩ সাল থেকে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন শুরু করেছে।
২০২৫ সালের মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শ্রেণি এবং ২০২৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি এ কারিকুলামের আওতায় আসবে। আশা করছি, ২০৩০ সাল নাগাদ এ কারিকুলামের মাধ্যমে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জিত শিক্ষার্থী আমাদের কর্মক্ষেত্রে পাব। আর এ অভিজ্ঞতাভিত্তিক কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য প্রাণভোমরা হিসেবে কাজ করছে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং সর্বোপরি মাঠপর্যায়ে কর্মরত শিক্ষক শ্রেণি।
নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করা দরকার—
১. বিদ্যমান অবকাঠামোয় এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন অবশ্যই সম্ভব বলে মনে করি। দেশে বিদ্যালয়ে যে পরিমাণ বিল্ডিং হয়েছে, সেগুলোকে আন্তরিকতা দিয়ে ব্যবহার করলে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হওয়ার কথা নয়। শুধু একটু পরিকল্পনা নিলেই এবং কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য সরকার কিছু বরাদ্দ দিলে বিদ্যমান অবকাঠামোয় সুষ্ঠু–সুন্দরভাবে এ কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কারিকুলাম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মাঠপর্যায়ে খেয়াল করলাম যে এখানে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মানবিক ও নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন হতে হবে। শিক্ষকদের আরও আন্তরিক হতে হবে। শিক্ষার জন্য সহায়ক উপকরণগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরবরাহ করবে। আর উপকরণগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে (শ্রেণিকক্ষে) থাকলে তারা স্বাধীনভাবে বিদ্যালয়ে নিজেদের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের অভিজ্ঞতাগুলো অর্জন করতে পারবে। তবে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘসময় বিদ্যালয়ে রেখে শিখন অভিজ্ঞতাগুলো অর্জন করাতে গেলে টিফিন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা জরুরি। বিদ্যালয়ে আমরা যে টিফিন দিচ্ছি তাতে শিক্ষার্থীদের পুষ্টি চাহিদার খুব সামান্যই পূরণ হচ্ছে। কার্যত টিফিনের নামে শিক্ষার্থীদের যেটা দিচ্ছি, সেটা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকার করছে? কারণ, বর্তমান যে বাজারব্যবস্থা, তাতে জনপ্রতি দৈনিক তিন থেকে চার টাকার টিফিনে একজন শিক্ষার্থীকে কতটা ভালো টিফিন দেওয়া সম্ভব?
২. স্বল্প সুযোগ-সুবিধা ও নিম্ন আর্থসামাজিক মর্যাদায় একজন শিক্ষককে দিয়ে এ কারিকুলাম বাস্তবায়ন কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা সত্যিই একটি বড় প্রশ্ন? শিক্ষকেরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে কতটা দুর্বল, তা শিক্ষকদের দিকে তাকালে সহজেই যে কেউ বুঝতে পারবেন। শিক্ষকদের দুর্দশার কথাগুলো এর আগেও কয়েকবার বলতে চেষ্টা করেছি, এখনো বলছি। শিক্ষকদের বেতন, পদোন্নতি বা অবসর–পরবর্তী সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা কোনোটাই যেসব দেশ থেকে কারিকুলাম আনা হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শুনেছি আরও ৫১টি দেশ এই কারিকুলাম চালু করেছে। ওই ৫১টি দেশের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা আর আমাদের দেশের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা তুলনা করে দেখতে কারিকুলাম আনয়নকারী কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি। কারণ, প্রেষণা থিওরি অনুযায়ী নিম্ন সুযোগ–সুবিধা নিম্ন প্রেষণার সৃষ্টি করে, ফলে শিক্ষকদের নিম্ন কর্মস্পৃহা সৃষ্টি হবে এবং ফলস্বরূপ নিম্নমানের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানবসম্পদ গড়ে উঠবে। তাই নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করতে গেলে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এ ছাড়া শিক্ষকতা পেশায় উচ্চ মেধাবীদের নিয়োগ ও ধরে রাখতে আকর্ষণীয় বেতন কাঠামো এবং নিয়মিত পদোন্নতির সুযোগ থাকতে হবে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় একটি সুস্পষ্ট মতবাদ আছে, কর্মে নিযুক্ত কোনো কর্মীর পূর্ণ মানুষিক পরিতৃপ্তির ওপর তার কাজের সফলতা নির্ভর করে।
৩. শিক্ষার্থী ভর্তি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না করলে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন জটিল হতে পারে। লটারি সিস্টেমে বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থী এক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার কারণে সবাই সমানভাবে শিখন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছে না। সুতরাং শিক্ষার সব স্তরে ও সব প্রতিষ্ঠানে একই ভর্তি পদ্ধতি চালু করা জরুরি।
৪. শিক্ষকদের সুযোগ–সুবিধা নিয়ে বললে এমপিওভুক্ত একজন সহকারী শিক্ষকের বেতন ১২,৫০০ টাকা আর বাড়িভাড়া ১০০০ টাকা, মেডিকেল ৫০০ টাকা, যা অত্যন্ত হাস্যকর। আর সরকারি হাইস্কুলে একজন সহকারী শিক্ষকের বেতন শুরু হয় ১৬ হাজার টাকা (দ্বিতীয় শ্রেণি/ ১০ম গ্রেড) সঙ্গে বাড়িভাড়া ও মেডিকেল যুক্ত থাকে। আর একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের মূল বেতন ১১,০০০/- টাকা (১৩তম গ্রেডে) সঙ্গে বাড়িভাড়া ও মেডিকেল যুক্ত থাকে। আর সব ক্যাটাগরির শিক্ষকের পাওনা থেকে কিছু অংশ কেটে রাখা হয় ভবিষ্যতে কিছু আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য। সবকিছু বাদ দিয়ে শেষে একজন শিক্ষক যা পান, তাতে কীভাবে তিনি পরিবারের ব্যয়ভার বহন করছেন? আর এ আর্থিক অশান্তির মধ্যে তিনি কতটা মনোযোগ দিয়ে শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন? পরিস্থিতি এমন যে শিক্ষকদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। এ অবস্থায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা তো একটু সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধির জন্য (জাতীয়করণের) আন্দোলন করছেন। সরকারের আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের প্রয়োজন।
আর সরকারি মাধ্যমিকে কর্মরত প্রায় তিন হাজার শিক্ষকের ২০১৫ সালে জাতীয় পে-স্কেলের আগের বকেয়া টাইম স্কেল সিলেকশন গ্রেড আদালতের রায় অনুযায়ী প্রদান না করার ফলে শিক্ষকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারি কলেজের ন্যায় মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারিকরণ স্কুলের জন্য একটি যৌক্তিক আত্তীকরণ বিধিমালা প্রণয়ন না করার কারণে সরকারি মাধ্যমিকে কর্মরত শিক্ষকদের স্বার্থ এবং মর্যাদা হ্রাস পাচ্ছে বলে সরকারি মাধ্যমিকে কর্মরত শিক্ষক–কর্মকর্তারা মনে করেন। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের সরকারি কলেজের মতো চার স্তরের গ্রেডভিত্তিক (চেয়ারভিত্তিক সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক পদোন্নতি প্রথা বাতিল করে) পদোন্নতি প্রথা চালু না করার কারণে (School & Inspection Branch) কর্মরত শিক্ষক–কর্মকর্তাদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে। তাই সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষকদের বর্তমান পদমর্যাদার আপগ্রেডেশন করা অর্থাৎ এন্ট্রি পদ ৯ম গ্রেড ধরে সরকারি কলেজের মতো চার স্তরের পদসোপান (Career Path) প্রণয়ন এবং নিয়মিত পদোন্নতি প্রথা চালু করা এখন সময়ের দাবি। এ চার স্তরীয় পদসোপান বাস্তবায়িত হলে মাধ্যমিকের কর্মরত শিক্ষক–কর্মকর্তাদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা নিয়ে যে বঞ্চনা, তার প্রায় ৯৫ ভাগ সমস্যার সমাধান হবে বলে মাধ্যমিকে কর্মরত শিক্ষক–কর্মকর্তারা মনে করেন। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে পদ–পদবি আপগ্রেড করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা মেনে ইতিমধ্যে বিভিন্ন দপ্তর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদনাম পরিবর্তন করেছে এবং পদের আপগ্রেডেশন চলমান।
৯ম গ্রেডে ২টি পদ সৃষ্টির (সিনিয়র শিক্ষক ৯ম গ্রেড, নন–ক্যাডার ও সহকারী প্রধান শিক্ষক ৯ম গ্রেড ক্যাডার) কারণে পদোন্নতি নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বিসিএস (Education: General education) composition and cadre Rules, 1980 ও Bangladesh civil service Recruitment, 1981 সংশোধন করাও অতীব জরুরি। অন্যথায় আগামী এক–দুই বছর পর মাউশির (School & Inspection Branch) প্রায় সব পদে (উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, সহকারী প্রধান শিক্ষক/ সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার/সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক/ পরিদর্শিকা, প্রধান শিক্ষক/জেলা শিক্ষা অফিসার/ বিদ্যালয় পরিদর্শক/ পরিদর্শিকা ও উপপরিচালক পদগুলোয়) সিনিয়র শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। এ জটিলতার কারণে কর্মরত শিক্ষক–কর্মকর্তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে পদোন্নতি না পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পদোন্নতি বন্ধ হওয়া বা পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার জন্য শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে, যা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
৫. চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছেন, দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের ২০ হাজার ৩১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এ ছাড়া তিন হাজারের কিছু বেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। অর্থাৎ ২৪ হাজারের কিছু বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে মাউশি গঠিত। বৃহৎ জনসংখ্যার এ দেশে সব স্তরেই অসংখ্য শিক্ষার্থী। এ হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ন্ত্রিত হয় একটি অধিদপ্তর অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর দিয়ে। ফলে কাজে গতিশীলতা নেই, শিক্ষকদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান মাউশি দিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনার মতো এত বড় কর্মযজ্ঞ মোটেই সম্ভব নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ১ হাজার ৮০০ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা ‘কারিগরি অধিদপ্তর’ ও ৯ হাজার ৬৫৬টি মাদ্রাসার জন্য আলাদা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর গঠিত হলেও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০–এর প্রস্তাবনা অনুযায়ী আলাদা মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা আটকে আছে বহু বছর। তাই বিদগ্ধজন মনে করেন, ২০৪১ সালের উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুযায়ী ভেঙে দুটি অধিদপ্তর তথা—(ক) মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও (খ) উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি।
১৯৯৯ সালের ২২ জুন নায়েমে ‘Bangladesh National Commission for UNESCO, Ministry of Education’ কর্তৃক আয়োজিত ‘Education For the 21st Century’ শীর্ষক সেমিনারে গৃহীত সুপারিশমালায় মাধ্যমিকের জন্য আলাদা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের শতকরা ৮০ ভাগ কর্মকর্তা কলেজের জনবল হওয়ায় মাধ্যমিকের শিক্ষকেরা অধিদপ্তরে কাজ করার তেমন সুযোগ পান না। তা ছাড়া মাধ্যমিকের সমস্যা সম্পর্কে কলেজ কর্মকর্তাদের বাস্তবজ্ঞান বা অভিজ্ঞতাও তুলনামূলকভাবে কম। ফলে একটি অধিদপ্তরের পক্ষে সবকিছু ভালোভাবে ম্যানেজ করা হয়ে উঠছে না। ফলে মাধ্যমিকের শিক্ষকেরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হলে শিক্ষকদের পদোন্নতিসহ অন্যান্য বৈষম্যমূলক অংশগুলোর কাজ ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
৬. অন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষকদের এ কারিকুলামের সঙ্গে পরিচিতি করানো, যেটা ইতিমধ্যেই অনেকটা সফলভাবে শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে কারিকুলামের জন্য নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। কিছু ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হলেও সর্বমহলে তা প্রশংসিত হচ্ছে এবং শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে সেটা গ্রহণও করেছে।
এ ছাড়া নতুন কারিকুলামের পাঠদান ও মূল্যায়ন ব্যবস্থায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এত দিন মূল্যায়নে যে প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহৃত হতো, এখন সেটা আর হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের দিয়ে নির্দিষ্ট কাঠামোবদ্ধ কিছু প্রশ্নের উত্তর লিখে সে উত্তর মূল্যায়ন করে ফলাফল প্রকাশের পদ্ধতি আর থাকছে না। এখন শিক্ষার্থী মূল্যায়ন করা হবে প্রতিটা মুহূর্তের। শিক্ষার্থী তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, চারপাশের পরিবেশ এবং বিদ্যালয়ে যে সময় কাটাবে, তার সবটাই মূল্যায়িত হবে। এককথায় শিক্ষার্থীর চারপাশে যেখানে তার বিচরণ রয়েছে, সেসব অংশ থেকে এ শিক্ষার্থীকে আলাদা আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হবে এবং একপর্যায়ে সব মূল্যায়নকে গড় করে চূড়ান্ত মূল্যায়ন ফলাফল প্রকাশ করা হবে এবং এ ফলাফল প্রকাশিত হবে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। এখানে শিক্ষাদানের পদ্ধতি হবে মূলত সহযোগিতামূলক, প্রতিযোগিতামূলক নয়। শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীদের সহায়তাকারী।
নতুন কারিকুলামে পাঠ হবে অভিজ্ঞতাভিত্তিক এবং প্রায় অধিকাংশ অভিজ্ঞতাই বিদ্যালয়ে অর্জিত হবে বিধায় প্রাইভেট টিউশনের কোনো প্রয়োজন পড়বে না। এখানে নোট, গাইড বা সহায়ক বইয়েরও কোনো প্রয়োজন হবে না। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ বা স্তর শেষে শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার স্তরগুলো মূল্যায়ন করে গড় ফলাফল দেওয়া হবে। এখন এখানে যে প্রাইভেট টিউশন ও সহায়ক বই বন্ধের কথা বলা হয়েছে এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক মনিটরিং। কারণ, অসাধু শিক্ষক যেমন রয়েছেন, তেমনিভাবে অসাধু কোচিং ও নোট–গাইড ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন। সুতরাং মনিটরিংয়ের জন্য শক্তিশালী ব্যবস্থা না নিলে নতুন শিক্ষাক্রমে যে টিউশন ও সহায়ক বইকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, সেটা কার্যত কাগজেই থেকে যাবে।
সুতরাং নতুন কারিকুলামে মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জ এসেছে, তা মোকাবিলা করা একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান মাউশিকে দিয়ে অসম্ভব। ফলে নতুন কারিকুলাম সফলভাবে বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
তাই, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে শিক্ষকসমাজের পক্ষ থেকে বিনীত অনুরোধ করব জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী আলাদা মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গড়ে তুলুন এবং সব পর্যায়ের শিক্ষকদের মর্যাদা এবং আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করুন।
শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী স্নাতকদের ধরে রাখতে আকর্ষণীয় ও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ও নিয়মিত পদোন্নতির জন্য সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদটি ৯ম গ্রেড করে সরকারি কলেজের ন্যায় চার স্তরীয় একটি ডায়নামিক পদসোপান (Career Path) তৈরি করুন। শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনুন। মাধ্যমিক শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিন এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার করুন। এতে শিক্ষাবান্ধব সরকারের নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের এ মহতী উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে বলে বিদগ্ধজন মনে করেন।
লেখক: সালাউদ্দিন, সহকারী শিক্ষক, ডুমুরিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, খুলনা।