ঢাকায় এমিলিয়ানো মার্তিনেজের সঙ্গে এক দিন

২০২৩ সালের ৩ জুলাই ভোরের আলো ফোটার আগেই বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। আর্জেন্টিনা ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনের অন্যতম একজন মার্তিনেজ। বিশ্বকাপে জিতে নেন গোল্ডেন গ্লাভস পুরস্কার।

মার্তিনেজ ঢাকায় আসছেন, খবরটি আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল ভক্তদের মধ্যে। তাই তো ভোর থেকেই বিমানবন্দরে ছিল ভক্তদের ভিড়। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাই আমি, তাঁর সফরের পৃষ্ঠপোষক ডিজিটাল ব্যবসায়িক গোষ্ঠী নেক্সট ভেনচার্সের প্রতিনিধিরা, মার্তিনেজের ভারতীয় সমন্বয়কারী শতদ্রু দত্তসহ আরও অনেকে। আমি তাঁকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত এবং খুবই আশ্চর্য হলাম যে এত বড় মাপের একজন ফুটবলার ১৮ ঘণ্টা জার্নি করে ঢাকায় এসেছেন, তারপরও তাঁর চেহারায় ক্লান্তির বিন্দুমাত্র ছাপ খুঁজে পাইনি। এ ছাড়া তিনি আমাদের সঙ্গে যেমন বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করেছেন, তা আসলেই প্রশংসার দাবিদার। বিমানবন্দরের ফরমালিটিজ শেষ করেই তাঁকে নিয়ে রওনা দিই গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনে।

এমিলিয়ানো মার্তিনেজ হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। তারপর আবার তাঁকে নিয়ে যাই নেক্সট ভেনচার্স আয়োজিত অনুষ্ঠানে। সেখানে তিনি আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার সঙ্গে মতবিনিময় করেন। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী তাঁকে পাটের তৈরি নৌকা ও বঙ্গবন্ধুর বই উপহার দেন। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের দর্শকদের আর্জেন্টিনার প্রতি ভালোবাসা দেখে তিনি সত্যিই আবেগাপ্লুত। মার্তিনেজ বাংলাদেশের দর্শকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং ভবিষ্যতে পুরো আর্জেন্টিনা দল নিয়ে বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।

পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী, তাঁকে নিয়ে রওনা দিই বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করানোর জন্য। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে হাস্যোজ্জ্বলভাবে স্বাগত জানান এবং নির্ধারিত সময়ের থেকে বেশি সময় ধরে খেলাধুলা নিয়ে আলোচনাও করেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন খেলাধুলা অনুরাগী মানুষ এবং মার্তিনেজকে পেয়ে তিনিও অনেক আনন্দিত। মার্তিনেজের সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী জানান ফুটবলসহ সব ধরনের খেলাধুলার সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সম্পর্কের কথা। প্রধানমন্ত্রীর বাবা ফুটবল খেলেছেন। এ ছাড়া তাঁর ভাই শেখ কামাল, যিনি আবাহনীর প্রতিষ্ঠা করেন, একজন দক্ষ খেলোয়াড় ছিলেন। মার্তিনেজ প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর স্বাক্ষরিত আর্জেন্টিনার একটি জার্সি শুভেচ্ছা উপহার দেন।

প্রধানমন্ত্রীও মার্তিনেজকে একটি নৌকা প্রতিকৃতি উপহার দেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বাংলাদেশ সরকারের সাত থেকে আটজন মন্ত্রী-সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম মার্তিনেজের সঙ্গে একটি ছবি ফেসবুকে আপলোড করেন। ১০ মিনিটে ১০ হাজারেরও বেশি ভিউ হয়, যেটি আসলেই অবাক করার মতো বিষয়। এ থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে মার্তিনেজের জনপ্রিয়তার পরিমাণ।

বাংলাদেশের ভক্ত-সমর্থকেরা এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে ‘বাজপাখি’ নামে ডেকে থাকেন। গত কোপা আমেরিকা ও বিশ্বকাপে অসাধারণ পারফর্ম করা আর্জেন্টিনার গোলরক্ষকের প্রতি আমাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এটি। নামটি সম্পর্কে জেনে মুগ্ধ তিনি এবং তাঁর খুবই পছন্দ হয়েছে। বাংলাদেশে সংক্ষিপ্ত সফরে পাওয়া আতিথেয়তা ছুঁয়ে গেছে তাঁর হৃদয়। এমিলিয়ানো আমাকে জানান, বাংলাদেশে ফিরতে অপেক্ষায় থাকবেন তিনি। যা শুনে আমি নিজেও অনেক আনন্দিত হয়েছি। আমি একটা বিষয় দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছি, সাধারণত লাতিন আমেরিকার ফুটবলাররা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু মার্তিনেজ এত সুন্দরভাবে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলেন, সত্যিই প্রশংসনীয়।

মার্তিনেজের সফর মূলত কলকাতায়। সেখানে যাওয়ার আগে বাংলাদেশে ভক্তদের আবেগের খানিকটা ছোঁয়া নিতেই তিনি ঢাকায় আসেন। বাংলাদেশে আর্জেন্টিনাকে ঘিরে যে তুমুল উন্মাদনা, যে আবেগের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল গত বিশ্বকাপ ফুটবলে, মাত্র ১১ ঘণ্টার সফরে সীমাবদ্ধতার কারণে সেসবের সঙ্গে সরাসরি পরিচয় হলো না মার্তিনেজের। তবে তিনি জানেন, আর্জেন্টিনাকে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনা কী পরিমাণ। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা, যত্ন ও আতিথেয়তায় তিনি মুগ্ধ। তাই তো তিনি যাওয়ার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে সফরের কয়েকটি ছবি আপলোড করে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে আমার ভ্রমণ ছিল অসাধারণ! এখানকার লোকেরা তাঁদের ভালোবাসা, যত্ন এবং অতুলনীয় আতিথেয়তা সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি অধীর আগ্রহে এই সুন্দর দেশে অদূর ভবিষ্যতে আবার ফিরে আসার প্রত্যাশা করছি।’ সবার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে মার্তিনেজ লেখেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, যাঁদের নামও হয়তো আমি জানি না। কিন্তু তাঁদের প্রচেষ্টা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। আমার পরবর্তী সফর পর্যন্ত আপনাদের বিদায় জানাচ্ছি।

আমার হৃদয়ের একটি অংশ বাংলাদেশে রেখে যাচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে মার্তিনেজকে সরাসরি বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। কলকাতার উদ্দেশে তাঁর ফ্লাইট ছিল বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাঁর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ আলাপ করার সুযোগ হয়। তিনি তখনো বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় তিনি মুগ্ধ। তিনি আবার বাংলাদেশে আসার প্রতিশ্রুতি দেন।

বাংলাদেশে ছেড়ে গেলেও এই চলে যাওয়াই শেষ নয় বলে আশ্বাস দিয়েছেন মার্তিনেজ। ভবিষ্যতে নিজে এবং পুরো আর্জেন্টিনা দল নিয়ে বাংলাদেশে আসবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। আমরাও আশা করি, তিনি বারবার আমাদের দেশে আসুক। আমাদের দেশের ফুটবলকে উৎসাহ দিক। বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার ভক্তদের ভালোবাসার প্রতিদান দিক।

  • লেখক: রিয়াজুল ইসলাম, কাউন্সেলর (শিক্ষা ও ক্রীড়া), বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন, কলকাতা, ভারত