প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবসা নয়—এটি জাতি গঠনের ভিত্তি
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিশুর চোখে থাকে স্বপ্ন—ভবিষ্যতের সম্ভাবনার, নিজের ও পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের। কিন্তু এই স্বপ্নপথ সহজ নয়। ক্ষুধার্ত পেট, পারিবারিক টানাপোড়েন, বৈষম্যময় বাস্তবতা—এসব নিয়েই তারা প্রতিদিন স্কুলে আসে।
সম্প্রতি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হয়েছে—এবার থেকে শুধুমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। এটি শুধু একটি প্রশাসনিক আদেশ নয়, বরং একটি ন্যায়বিচার।
বহু বছর ধরে দেখা গেছে, অনেক শিক্ষার্থী নামমাত্র সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি থাকলেও তারা সারা বছর প্রাইভেট বা কেজি স্কুলে পড়েছে। বৃত্তি পরীক্ষার সময় এসে কেবল সরকারি পরিচয়ে সুযোগ নেয়। এতে প্রকৃত সরকারি বিদ্যালয়ের শিশুরা বারবার বঞ্চিত হয়। এই অনৈতিক চর্চা বন্ধ হওয়া সময়ের দাবি ছিল।
শিক্ষকের বাস্তবতা—
আজকের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আধুনিক, মানবিক ও সচেতন। তাদের অনেকেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী, প্রশিক্ষিত ও প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদানে দক্ষ। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তাদের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা অন্য সরকারি চাকরির তুলনায় বৈষম্যমূলকভাবে কম।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা তাদের কর্মক্ষমতাকেও প্রভাবিত করে। সীমিত বেতন, পেশাগত স্বীকৃতির অভাব ও জীবনযাত্রার চাপ অনেক শিক্ষককে পাঠদানে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে বাধাগ্রস্ত করে। অথচ তারাই জাতি গঠনের কারিগর। তাই শিক্ষকের মর্যাদা, ন্যায্য সুযোগ ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
শিক্ষার্থীদের বাস্তবতা—
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী আসে সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে—
যাদের ঘরে পর্যাপ্ত খাবার নেই
পড়ার মতো শান্ত পরিবেশ নেই
পরিবারে শিক্ষার গুরুত্ব নেই
তবু তারা প্রতিদিন স্কুলে আসে; কারণ, তারা জানে—শিক্ষাই তাদের মুক্তির একমাত্র পথ।
তুলনা যদি করতেই চান, তাহলে করুন—
কে পেটভরে খেতে পারে, আর কে খালি পেটে পড়ে
কার মৌলিক অধিকার পূর্ণ হয়, আর কে শুরু থেকেই বঞ্চিত
কার কাছে শিক্ষা ভবিষ্যতের সিঁড়ি, আর কার কাছে বিলাসিতা
আমরা ভুলে গেছি কিছু মূল্যবান বিষয়
একসময় দেশে এত কেজি স্কুল ছিল না, ছিল না মুখস্থবিদ্যার প্রতিযোগিতা। কিন্তু ছিল মানসম্মত পাঠদান, নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ। আজ যত্রতত্র প্রাইভেট স্কুলগুলো অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাকে বানিয়ে তুলেছে এক ব্যবসায়িক পণ্য।
প্রয়োজন যে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার—
সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পুষ্টিকর খাবার, পোশাক, পাঠ্যবই, প্রযুক্তি ও নিরাপদ পরিবেশ
শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক বেতন, প্রশিক্ষণ, পেশাগত নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা
শিক্ষাকে শুধু ফলাফলের নিরিখে না দেখে একটি মানবিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা
এ সিদ্ধান্ত কেবল বৃত্তিসংক্রান্ত নয়—এটি একটি বার্তা যে সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই মর্যাদার দাবিদার।
আমার বিশ্বাস, আমাদের এই শিশুরাই একদিন আলো হয়ে উঠবে। তারা সমাজের বুকে নিজের জায়গা করে নেবে—সততা, মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে।
কারণ, শিক্ষা কোনো পণ্য নয়—এটি মানবাধিকারের অংশ। আর এই অধিকারের প্রহরী আমরা—সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
লেখক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী শিক্ষক, কোন্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উপজেলা সাভার, ঢাকা