আরণ্যকের উজাড় বনের স্মৃতি ফিরে আসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে
বিভূতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসের বনহারানো ব্যথা, মানুষের লোভে জঙ্গল সরে যাওয়ার হাহাকার আমাকে বারবার কষ্ট দেয়। আরণ্যকের বন যেমন মানুষের হাতের কাছে এসে ধ্বংস হয়েছিল, মহাসড়কের সবুজও তেমনি ধীরে ধীরে নির্বাসনে চলে যাচ্ছে; শুধু পার্থক্য উপন্যাসে ব্যথা ছিল শব্দে, বাস্তবে ব্যথা ঝরছে বাতাসে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার বেলতলী এলাকায় সম্প্রতি বকুল, বেলীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক ফুল গাছ কেটে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। কুমিল্লার কাগজে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেখে চমকে গেলাম! ইতিমধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছে। এরপর সংবাদমাধ্যমে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে আরও বিস্তারিত জানার প্রবল ইচ্ছা হলো। এই ঘটনা নতুন নয়, এর আগেও ঘটেছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য বলছে, কয়েক মাস আগে একই মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম উপজেলার হায়দারপুল থেকে ফাল্গুনকরা মাজার এলাকায় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রায় ৫০টি ফুল গাছ। ধারাবাহিকভাবে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি মহাসড়কের সবুজায়ন কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ও পরিচালনা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে। মহাসড়কের এই সবুজ করিডর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশগত ঝুঁকিও বাড়ছে। ফুল গাছ ও ছায়াবৃক্ষ ধুলা কমায়, কার্বন শোষণ করে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে এবং প্রাকৃতিক শব্দ-বাফার হিসেবে কাজ করে। এমন গাছ নির্বিচার সরিয়ে ফেললে পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নিশ্চিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফল গাছ দ্রুত বড় হয়ে যানবাহনের দৃষ্টিসীমা বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং ঝড়বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনাও তুলনামূলক বেশি—যা মহাসড়কের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
সম্প্রতি যে ঘটনাটি ঘটেছে, তার একটু বিস্তারিত তুলে ধরা যাক। মহাসড়কের মতো জায়গায় গাছ কাটার ঘটনায় তদারকির দুর্বলতাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এত বড় পরিসরে গাছ কাটার ঘটনা কীভাবে, কার নির্দেশে, কোন নীতিমালা অনুসরণ করে ঘটল—এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব এখনো পাওয়া যায়নি। সরকারি অর্থায়নে করা সবুজায়ন প্রকল্পের বিরুদ্ধে এমন কার্যক্রম চলতে থাকলে উন্নয়ন পরিকল্পনার স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা নিয়েও উদ্বেগ সৃষ্টি হবে। পরিবেশ ও সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও মাঠপর্যায়ে সেগুলোর প্রয়োগ কতটা হচ্ছে, তা–ও পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
সড়কের পাশে লাগানো গাছ কেবল সৌন্দর্য নির্মাণের উপাদান নয়—এগুলো পরিবেশ রক্ষা, নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা এবং দীর্ঘ মেয়াদে মহাসড়কের টেকসই ব্যবস্থাপনার অংশ। তাই পরিকল্পিতভাবে লাগানো গাছ যদি বিনা অনুমতিতে বা যথাযথ মূল্যায়ন ছাড়া সরিয়ে ফেলা হয়, তাহলে ক্ষতিটি হবে বহুমাত্রিক—পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন ব্যয়ের সব জায়গায় এর প্রভাব পড়বে। বেলতলীর এই ঘটনা স্পষ্ট করে দেয়—মহাসড়কের সবুজায়ন রক্ষায় শক্তিশালী নজরদারি, সুসংগঠিত সমন্বয় এবং কঠোর জবাবদিহি এখন সময়ের দাবি। নইলে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা সবুজ করিডর হারিয়ে যাবে, আর তার পরিণতি বহন করতে হবে পরিবেশ ও পথচারী—উভয়কেই।
লেখক: প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা, আশা ইউনিভার্সিটি।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]