চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তা বনাম দক্ষতা উন্নয়ন
বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবন-আবিষ্কার, সৃজন, শিখন, জ্ঞান অর্জন তথা নিজেকে সমৃদ্ধ করার মুক্তপ্রাঙ্গণ। প্রতিবছর অসংখ্য গ্রাজুয়েট দক্ষ, যোগ্য, সৃজনশীল জনশক্তি হয়ে বেরিয়ে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে। যাঁরা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি তথা দেশকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখে। আবার অনেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেও নিজেকে একটি পছন্দসই জায়গা দাঁড় করাতে হিমশিম খায়। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যেমন অনেকে আদাজল খেয়ে নামেন নিজেকে ভালো একটি অবস্থানে দাঁড় করাতে, তেমনি অনেকে হেলায় ফেলায় সময় নষ্ট করে বের হন শূন্য হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল ক্যাম্পাসে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পায় দরুণ সব সুযোগ। নিজ ডিপার্টমেন্ট ছাড়াও অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থী, নানান জেলা থেকে আসা বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেশার ফলে পরিবর্তন আসে একজন শিক্ষার্থীর আচরণ, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে নানান সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। এসব সংগঠনে যুক্ত হয়ে নেতৃত্বের গুণাবলি থেকে শুরু করে তৈরি হয় কাজ করার স্পৃহা। জড়তা কাটিয়ে নিজেকে মেলে ধরার চমৎকার উর্বর জায়গাও বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অর্থাৎ অনার্সে পা রাখার পরপরই অনেকের মাথায় নাড়াচাড়া দিয়ে বসে বিসিএস নামের এক সোনার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন পূরণে চলে দিন-রাত নানা গাইড–নোট মুখস্থ করার ধুম। কোচিংয়ে আসা-যাওয়া, গাইড নোট থেকে প্রশ্ন মুখস্থ করা আবার কদিন পর ভুলে যাওয়া, এভাবে চলতেই থাকে অনেকের। আবার অনেকে সিজিপিএ ভালো করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। বিভাগে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ার স্বপ্নও উঁকি দেয় কারও কারও মনে। আবার অনেকে সবকিছুর মধ্যে ব্যালান্স রেখে চলেন। অনেকেই তো বলে ফেলেন, ওকে দিয়ে কিছু হবে না। ও শুধু এদিক–ওদিক সংগঠন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, চাকরির জন্য নেই কোনো পড়াশোনা, নেই সিজিপিএ ভালো করার কোনো চেষ্টা। অনেকের ধারণা, সারা দিন এমপি-থ্রি নিয়ে দৌড়িয়ে কী হবে, বিসিএস না হলে সব জলে। যে যা–ই ভাবুক। একটি ভালো ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি আমাদের একজন ভালো ও যোগ্য মানুষ হওয়া চাই। তার জন্য দরকার নিরন্তর ছুটে চলা ও সবকিছুর মধ্যে সমন্বয় (বিভাগের পড়াশোনা, সহশিক্ষা, চাকরির প্রস্তুতি, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন)।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ভালো একটা চাকরি প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু ভালো মানুষ হওয়ার জন্যও থাকতে হবে সাধনা ও নিরলস প্রচেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজের গ্রন্থাগারে নতুন-পুরোনো বইয়ের বিশাল সংগ্রহ থাকে। একটু ডুব দিন না এ লাইব্রেরি নামক মহাসাগরটিতে। দেখবেন, কত কিছুই না কুড়াতে পারছেন। পরিচিত-অপরিচিত কত কিছু! গবেষণায় হাতেখড়িটা হয়ে যাক অনার্সের শুরু থেকেই। নিয়মিত লাইব্রেরি ওয়ার্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিন্তাভাবনা শুধু চাকরিকেন্দ্রিক না হয়ে যদি নিজেকে যোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টা হয়, তাহলে একদিন চাকরিই খুঁজে নেবে আপনাকে। টাইপিং, ভাষান্তর, সম্পাদনা, রিসার্চ, উপস্থাপনা, আয়োজন করা দক্ষতা, ম্যানেজমেন্ট স্কিল—এই বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে শেখা জরুরি। শুধু কয়টা নোট–গাইডে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বই-পুস্তক, অনলাইন-অফলাইন সব জায়গা থেকেই শেখার আছে। মনে রাখা দরকার, প্রতিদিনই হুহু করে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। নিত্যনতুন প্রযুক্তি এসে কর্মসংস্থান সংকীর্ণ করে দিচ্ছে। সম্প্রতি চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে ‘অপরাজিতা’ নামক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে খবর পড়ানো হয়। সামনে অনেক কাজই মানুষের পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট দিয়ে করানো হবে। অন্যদিকে চাকরিপ্রত্যাশীর সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। এত এত চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে নিজেকে টিকিয়ে রাখা চ্যালেঞ্জ বৈকি। দেখা যায়, অল্প কয়েকটি পদের বিপরীতে আবেদন অবিশ্বাস্যসংখ্যক! সুতরাং বেকারের খাতায় নিজের নাম না দেখতে যোগ্যতা অর্জনের বিকল্প নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় যেমন জ্ঞান অন্বেষণের মুক্তপ্রাঙ্গণ, তেমনি এখানে অবসর সময় কাটানোর জন্য রয়েছে চমৎকার মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নানান অবকাঠামো। আপনি চাইলে আপনার বন্ধুদের নিয়ে বসাতে পারেন আড্ডার (জাতীয়, আন্তর্জাতিক, অর্থনীতি, ইতিহাস, সাহিত্য, ভূগোলসহ নানান বিষয়ে) আসর। এমনিতেই বিভিন্ন সংগঠন পাঠচক্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে আয়োজন করে থাকে। সেখানে যুক্ত হয়েও নিজেকে একটু আপডেট করা যায়।
পরিতাপের বিষয় হলো, অনেকে স্কিল ডেভেলপ, নিজেকে জনশক্তি করা তথা যোগ্য নাগরিক হওয়ার কথা ভুলে অসৎ সঙ্গ, অবৈধ প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে কিংবা অবহেলায় নিঃশেষ করে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবান সময়টুকু। যা কখনো কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে অভিভাবকদের সন্তানের ওপর থাকে আস্থা ও বিশ্বাস—তাঁর সন্তান মানুষের মতো মানুষ হয়ে বের হবে, ভালো একটি কর্মসংস্থান হবে তার। আমাদের উচিত, তাঁদের এ বিশ্বাসের মর্যাদা রাখা। প্রোডাক্টিভ কত কাজেই তো রয়েছে, দেখুন না আপনি কোনটিতে পারফেক্ট। নিজেকে প্রোডাক্টিভ করে তুলতে হবে। ভালো একটি চাকরি হবে তো—এ নিয়েই তো দুশ্চিন্তা? সৃজনশীল, কর্মদক্ষ মানুষকে কখনো বেকার বসে থাকতে হয় না। কাজেই চাকরির জন্য চিন্তা না করে ভাবা উচিত দক্ষতা উন্নয়ন নিয়ে। চাকরির পিছুপিছু যেন ঘুরে বেড়ানো লাগে, তার জন্য কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে নেওয়া উচিত নয় কি অনলাইন-অফলাইন সব খানে, সব সময়? এটা ভুলে গেলে চলবে না, সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে সবার আগে।
*লেখক: মারুফ হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়