হালদার সচেতনতায় আমরা
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম। দেশের মিঠাপানির মাছের অন্যতম প্রাকৃতিক প্রজনস্থল চট্টগ্রামের হালদা নদী। তবে কালের বিবর্তনে নেতিবাচক নানাবিধ কারণে হারাতে বসেছে হালদা নদী ও নদীর জীববৈচিত্র্য।
আমরা সবাই চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। সম্প্রতি আমাদের একাডেমিক এনভায়রনমেন্টাল রিপোর্টিং কোর্সের ফিল্ড ওয়ার্কের অংশ হিসেবে হালদা ভ্রমণ ও সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করার সুযোগ হয়েছে।
হালদা রক্ষায় জেলে ও স্থানীয় জনসাধারণকে সচেতন করার পাশাপাশি হালদাপারের জেলেদের জীবন, নানা সংগ্রাম, এখানকার জীববৈচিত্র্য, প্রাণপ্রকৃতি, ইতিহাস–ঐতিহ্য ইত্যাদি জানা ও দেখা ছিল আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য।
আমাদের কোর্স শিক্ষক ও ব্যাচের ১০ জন শিক্ষার্থী আমরা হালদা ভ্রমণে অংশ নিই। বেলা ১১টায় আমরা রওনা হই। ঘণ্টাখানেকের কম সময়ের মধ্যেই আমরা হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শায় হালদার পাড়ে পৌঁছে যাই।
দুটি নৌকা ভাড়া করে দুটি গ্রুপ নেমে পড়ি হালদার পানিতে। হালদার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট ডিঙি। মূলত এসব ডিঙিতে করে মানুষ যেমন হালদার সৌন্দর্য উপভোগ করেন, তেমনি প্রজনন মৌসুমে জেলেরা ডিম সংগ্রহ করেন।
আমাদের ছোট দুটি ডিঙি চলছে, হালদার জলাধারের সঙ্গে আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি। মাঝেমধ্যে ডিগবাজি দিয়ে সবাইকে চমকে দিচ্ছে দুই–একটি শুশুক। নৌকার বইঠা চালাতে চালাতে মাঝিমাল্লাদের বিভিন্ন লোকজ গান, প্রাকৃতিক পরিবেশ, হিমেল হাওয়া আর পানির স্রোতের শব্দে অন্য রকম অনূভুতি তৈরি করে হালদা নদী।
হালদা নদীকে স্থানীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয়। মাছ ধরার পাশাপাশি মাছের ডিম সংগ্রহ এবং পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে হাজারো মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। হালদা বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে রুইজাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ) নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।
তবে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, অবৈধভাবে মাছ শিকার, শিল্পকারখানার বর্জ্য, অবৈধ বালু উত্তোলন, নদীর বাঁক কাটাসহ নানা কারণে হালদা নদীর পানিতে কমেছে মাছের সংখ্যা। সেই সঙ্গে চরম হুমকির মুখে পড়ছে এখানকার জীববৈচিত্র্য। হালদা রক্ষায় নেই তেমন কোনো পদক্ষেপ। তবে তরুণ প্রজন্ম যদি হালদার ইতিহাস–ঐতিহ্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে না জানে কিংবা সচেতন না হয়, সে ক্ষেত্রে অচিরেই হারিয়ে যাবে চট্টগ্রামের সুখ হালদা।
আমরা ১০ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড নিয়ে যাই। আমাদের প্রতিটি প্ল্যাকার্ডে ছিল সচেতনতামূলক বার্তা। আমরা স্থানীয় জেলে ও আশপাশের জনসাধারণকে হালদা কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং হালদা রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করেছি।
হালদাপারের লোকজন এবং জেলেদের চোখে-মুখেও আছে নানা সংগ্রামের গল্প। হালদা নদীর ওপর ভর করেই অসংখ্য মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন। এখানকার জেলেরা জানান, হালদা নদীর প্রজনন সময় হচ্ছে এপ্রিল, মে ও জুন—এই তিন মাস। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে তিথি বলা হয়। স্থানীয় জেলেরা ডিম ছাড়ার তিথির পূর্বেই নদীতে অবস্থান নেন এবং ডিম সংগ্রহ করেন। ডিম সংগ্রহ করে তাঁরা সারা দেশে বিভিন্ন বাণিজ্যিক হ্যাচারিতে বিক্রি করেন।
হালদা শুধু একটি নদী নয়, এটি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। হালদা কেবল চট্টগ্রামের জলাধার নয়, এর সঙ্গে জুড়ে আছে এই অঞ্চলের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অর্থনীতি। হালদার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ঘিরে গড়ে উঠেছে গান, সিনেমা, লোকশিল্প। কোনো কারণে যদি হালদা নদী বিপন্ন হয়, তাহলে চট্টগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রাই বিপন্ন হবে।
হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় হালদাপারের মানুষদের সম্পৃক্ত করা এবং ডিম আহরণকারীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং একই সঙ্গে হালদাপারের মানুষদের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। হালদা নদী বাঁচলে দেশের অর্থনীতি বেঁচে থাকবে। হালদাকে বাঁচাতে সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
লেখা: সাফিনাতুন জাহান সাবরিন, শিক্ষার্থী
**নাগরিক সংবাদ-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]এ