৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি: বাংলাদেশে নাজমুল করিম চর্চা

আবুল খায়ের নাজমুল করিমছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাসে আবুল খায়ের নাজমুল করিম চিরভাস্বর। ১৮ নভেম্বর ছিল তাঁর ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ১৯২২ সালের ১ আগস্ট নোয়াখালীর এক শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ফাল্গুনকরা গ্রামে। তিনি তাঁর পিতামাতার আট সন্তানের মধ্যে সপ্তম। ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ অনার্স ও ১৯৪৬ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৪৯-৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের খণ্ডকালীন প্রভাষক নিযুক্ত হন এবং ১৯৫০ সালে একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে যথাক্রমে সরকার ও সমাজবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এ সময়ে তাঁর থিসিস সুপারভাইজার ছিলেন মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট এম ম্যাকাইভার। এরপর ১৯৫৭ সালের ১ জুলাই একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হলে তিনি একই বছরের ১৯ আগস্ট সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। তিনি ১৯৬১ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে পিএইচডি করেন। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী টি বি বটোমোরের তত্ত্বাবধানে তাঁর গবেষণাকর্মটি সম্পাদন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ২২ বছর শিক্ষকতা করেন।

অধ্যাপক নাজমুল করিম যেমন বিশ্বখ্যাত পণ্ডিতদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তেমনি তাঁকে দেখেও অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। জীবনের নানা পর্যায়ে তিনি বহু সমাজচিন্তাবিদ ও পণ্ডিত শিক্ষকদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। তাঁদের মধ্যে রবার্ট এম ম্যাকাইভার, টি বি বটোমোর, হার্বার্ট মার্কুইজ, জন ই ওয়েন, মরিস জিন্সবার্গ, রেমন্ড ফার্দ, পেইরি বেসেইনে, সি রাইট মিলস, এস এম লিপজেট, দেবেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, অজিত কুমার সেন, অবনী ভূষণ রুদ্র, এ কে ঘোষাল, জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এনামুল হক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, মোজাফ্ফর আহমেদ, শহীদ এ এফ এম আলীম চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দীন অন্যতম।

নাজমুল করিম লিখতে, পড়তে ও শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করতে পছন্দ করতেন। তাঁকে দেখা যেত হয় লিখেছেন, না হয় পড়াশোনা করছেন। বাড়িতে তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল। শুধু সমাজবিজ্ঞানের নয়, দর্শন, ইতিহাস, ধর্ম, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সাহিত্য-শিল্পকলার মতো প্রায় প্রতিটি বিষয়ের বই-ই তাঁর ভান্ডারে ছিল। ইবনে রশীদ ছদ্মনামে তিনি গবেষণাপত্র, বই ও ছোটগল্প লিখতেন। তিনি মুসলিম অভিজাত মধ্যবিত্ত, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ভূগোল ও ভগবান, ধর্ম, মার্ক্সবাদ, পদ্ধতি, পরিবার, অপরাধ ইত্যাদি বিষয়ে সমাজতাত্ত্বিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি ‘ফাল্গুনকরা’ (১৯৫৮), ‘চেঞ্জিং সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ (১৯৫৬), ‘দি ডায়নামিকস অব বাংলাদেশ সোসাইটি’ (১৯৮০) ও ‘সমাজবিজ্ঞান সমীক্ষণ’ (১৯৭২) শিরোনামে চারটি গ্রন্থ রচনা করেন, যা বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, নিজ ভাষায় শিক্ষাদান বিদেশি ভাষার চেয়ে অধিক ফলপ্রসূ হয়। স্বাধীন দেশে বাংলা মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ বাংলায় লিখিত ও অনূদিত হয়। এ ক্ষেত্রে তাঁর অবদানই অগ্রগণ্য। আজীবন জ্ঞান সাধনা যেমন—নাজমুল করিমের ব্রত ছিল, তেমনি হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে প্রকৃত জ্ঞানসাধকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। দীর্ঘদিন কিডনি ও বহুমূত্র রোগে ভোগার পর ১৯৮২ সালের ১৮ নভেম্বর ষাট বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। তিনি স্ত্রী ও তিন কন্যা রেখে যান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা, সমাজ গবেষণা ও বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে গ্রন্থ রচনায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তবে অধ্যাপক নাজমুল করিমের সমাজ ভাবনা, বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা এবং বিকাশে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সমাজচিন্তকদের মধ্যে আলোচনা ও পর্যালোচনা নেই বললেই চলে। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন বলেছেন, ‘তিনি (নাজমুল করিম) একজন বহমাত্রিক মানুষ ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে এ দেশের মানুষ এখনো ভালোভাবে জানে না। তাঁর অবদানও জানে না। তাঁর যথার্থ পরিচয় বাঙালির কাছে তুলে ধরার কাজটি এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে।’ যদিও অধ্যাপক আফসার উদ্দীন সম্পাদিত নাজমুল করিম স্মারকগ্রন্থ (২০০০) এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এ গ্রন্থে অধ্যাপক আফসার উদ্দীন বলেন, সমাজ দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে একমাত্র নাজমুল করিমই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি সমাজব্যবস্থাকে সঠিক বিশ্লেষণ করতে পেরেছিলেন। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক রংগলাল সেনের ভাষ্য হলো, সমাজবিজ্ঞান চর্চায় ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে দুজন পথিকৃৎ ছিলেন, তাঁরা হলেন অজিত কুমার সেন ও এ কে নাজমুল করিম।

১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ‘মারকুইস হুজ হু’ এবং ১৯৮২ সালে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ থেকে প্রকাশিত ‘হুজ হু’-তেও তাঁর জীবনকর্ম ও বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানে অবদান স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি ১৯৮৩ সালে এশিয়ার নোবেল হিসেবে খ্যাত র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পদকের জন্য মনোনীত হন। তাঁকে ২০১২ সালে শিক্ষায় মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

নাজমুল করিম সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দীন আহমেদের নাজমুল করিমের ১০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লিখিত ‘ইন মেমোরি অব মাই টিচার গেস’ ও অধ্যাপক নাজমুল করিমের কন্যা লামিয়া করিমের ‘মেমোরিজ অব মাই ফাদার’ শিরোনামে দুটি প্রবন্ধের মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য আবিষ্কার করি এবং তাঁর সম্পর্কে জানতে আরও আগ্রহী হয়ে উঠি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশের প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নাজমুল করিম ছিলেন একাধারে শিক্ষক, সমাজ দার্শনিক, বিজ্ঞানমনস্ক এবং বিচিত্র মননশীলতার অধিকারী। দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে বলেন, মানুষ তার কর্মের ফল। মানুষ যেখানে নিরাকার ও অস্তিত্বহীন, কর্মই সেখানে প্রবল শক্তিরূপে বিরাজমান। অধ্যাপক নাজমুল করিমের কর্মই তাঁকে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের মতো শ্রেণিবিভক্ত সমাজকে তিনি জানতেন, বুঝতেন ও এর পরিবর্তনের কথা ভাবতেন। বাঙালি মুসলিম সমাজকাঠামো ও স্তরবিন্যাস বিশ্লেষণে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। তাঁর শিক্ষকতা, গ্রামীণ সামাজিক স্তরবিন্যাস ও মুসলিম ক্ষমতাকাঠামোবিষয়ক মৌলিক গবেষণা বাংলাদেশি সমাজবিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করে এবং সমাজবিজ্ঞানকে দেশে সামাজিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত করেন। এ ছাড়া বিভাগীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠা, মনোগ্রাফ লেখার ব্যবস্থা, গ্রামীণ প্রশ্নমালা পূরণের কার্যক্রম সবই নাজমুল করিমের অবদান। শুধু এ দেশে সমাজবিজ্ঞানের জনকই নন, তিনি দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একজন মিশনারির মতো ঐকান্তিকতা, উদ্যোগ ও পরিশ্রম নিয়ে কাজ করে গেছেন।

৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকীকে তাঁর প্রতি বিনম৶¤শ্রদ্ধা।

*লেখক: খ. ম. রেজাউল করিম, সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর