র‍্যাগিং সংস্কৃতি কি বন্ধ হবে না

নতুন বছরে নতুন আশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাসে পা রাখা নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যসূচি, শিক্ষক বা আনুষঙ্গিক বিষয়াদি নয়, সবচেয়ে বড় ভয়ের বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয় র‍্যাগিং নামক অপসংস্কৃতি।

যেখানে পরিচয়পর্বের নামে চলে মানসিক নির্যাতন। র‍্যাগিংয়ের মূল লক্ষ্যই থাকে প্রবীণ শিক্ষার্থী কর্তৃক নবীন শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা। একাধারে তাঁদের মৌখিক গালিগালাজ করা, বিভিন্ন অপমানজনক কাজ করতে বাধ্য করা ও বিভিন্ন দুঃসাহসী কাজ করতে বলা হয়। এমনকি সরাসরি তাঁদের গায়ে হাতও তোলা হয়।

র‍্যাগিং মূলত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, অর্থাৎ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে প্রচলিত রয়েছে। প্রতিবছর দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়রদের কাছ থেকে র‍্যাগিংয়ের নামে প্রচণ্ড হেনস্তার শিকার হয়েছেন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। এর ফলে কেউ কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, কেউ আবার অপমানে আত্মহত্যার চিন্তাভাবনাও করতে থাকেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এত দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাপারে মনে যেসব রঙিন স্বপ্নের আঁকিবুঁকি কেটে এসেছেন তাঁরা, সেগুলো এক ফুঁতে উড়ে যায়। ডিপ্রেশন নামক মানসিক রোগের সঙ্গে তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পরই পরিচিত হন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা শিক্ষার্থীদের জন্য নিজেদের প্রকাশ করার বাধাহীন মুক্তমঞ্চ, কিন্তু এখানে এসেই তাঁদের হতে হয় একপ্রকার মানসিক দাসত্বের নিগড়ে বন্দী।

প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন ছোট-বড় র‍্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটে থাকে। প্রকাশ্যে আসে না বলে সেগুলো আমাদের অজানা থেকে যায়। কিন্তু তলে তলে এর বিরূপ প্রভাব ঠিকই পড়তে থাকে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করা শিক্ষার্থীদের ওপর। কেউ কেউ এগুলোকে মেনে নিতে শিখে যান। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, কারও কারও কাছে এগুলোকে অতি স্বাভাবিক ঘটনা মনে হয়। যে কারণে পরের বছর সিনিয়র হওয়ার পর তাঁরাও জুনিয়র শিক্ষার্থীদের র‍্যাগ দিতে শুরু করেন। এভাবে র‍্যাগিং নামক ভয়াবহ সংস্কৃতি উত্তরাধিকার সূত্রে এক বর্ষের শিক্ষার্থীদের থেকে অন্য বর্ষের শিক্ষার্থীদের হাতে হস্তান্তর হতে থাকে। এটি অনেকটা যেন এমন একটি চক্র, যার শুরু হয়েছিল কোনো একদিন ঠিকই, কিন্তু শেষ আছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না।

র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় যাঁরা জড়িত থাকেন, তাঁদের অধিকাংশ ইমিডিয়েট সিনিয়র। তাঁরা প্রথম বর্ষে থাকাকালে র‌্যাগিংয়ের শিকার হন। ফলে পরবর্তী ব্যাচ আসার সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপিয়ে পড়েন।

উচ্চশিক্ষা সহজ থেকে সহজতর হতে থাকায় এর মূল্য যেন কমতে শুরু করল। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে প্রতিটি ব্যাচেই এমন কিছু শিক্ষার্থী দেখা যেত, যাঁদের কাছে মনে হতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারা মানেই জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য লাভ হয়ে গেছে, এখন আর নতুন করে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু শেখার নেই। এ ধরনের শিক্ষার্থীরা র‍্যাগিং সংস্কৃতিকে বর্তমানের ভয়াবহ রূপে নিয়ে আসতে শুরু করলেন। তাঁরা নিজেরা ক্লাস-পরীক্ষা ইত্যাদির পরোয়া করতেন না, আর তাই অন্যদেরও এমনটিই মনে করতেন। অন্য সবকিছুর চেয়ে র‍্যাগিংয়ের মাধ্যমে জুনিয়রদের ‘ভদ্রতা শেখানো’ই তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, বর্তমান সময়ে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিং নিয়ে বেশি মাতামাতি করেন, তাঁদের মানসিকতা ঠিক একই রকম।

অনেক শিক্ষার্থী র‍্যাগিং নামক মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেন। প্রথম বর্ষে তাঁরা মুখ বুজে র‍্যাগিং সহ্য করেন এবং এক বছরের সিনিয়র হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা নিজেরাও জুনিয়রদের র‍্যাগ দিতে শুরু করেন। এর পেছনে কিছু সাধারণ মানসিকতা লক্ষ করা যায়। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, ‘আমরা যেহেতু র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়েছি, তাই আমাদের জুনিয়রদেরও আমরা র‍্যাগ দেব।’ অনেকে আবার মনে করেন, র‍্যাগিং বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের অংশ। ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে যেসব প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে, র‍্যাগিংয়ের মাধ্যমে সেগুলোর সঙ্গে আগাম পরিচিত হয়ে যাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের যেন ডানা গজায়। সেই ডানা ছেঁটে দিতে এবং তাঁদের ভদ্রতা শেখাতে র‍্যাগিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। বরং র‍্যাগিং হলো তাঁদের জন্য একটি ‘রিয়েলিটি চেক’।

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আবেগের জোয়ারে ভেসে না গিয়ে একটি নিয়মতান্ত্রিক জীবনের অনুসারী হওয়া প্রয়োজন। ক্যাম্পাস ও হলের সিনিয়রদের থেকে শুরু করে নিজের ও বাইরের বিভাগের সব শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া একান্ত জরুরি। কিন্তু এগুলো শেখানোর নাম করে কোনো শিক্ষার্থীকে র‍্যাগ দেওয়া, তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক হওয়া উচিত পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও স্নেহের। কিন্তু কারও কাছ থেকে জোরপূর্বক সম্মান আদায় করতে তাঁকে ভয় দেখানো বা তাঁর গায়ে হাত তোলা সঠিক পথ হতে পারে না। আর তাই র‍্যাগিং সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় কত সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী যে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পরিবেশের বিরূপ পরিবেশ সহ্য করতে না পেরে আমাদের অগোচরে ঝরে যাবেন, তা আমরা কোনো দিন জানতেও পারব না।

*লেখক: রিয়া রানী মোদক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়