‘মা আর পারছি না, আর ইচ্ছা করছে না’

ফাইল ছবি

আমি একজন মা। সবেমাত্র আমার সন্তান উচ্চশিক্ষার সুযোগের জন্য এক ভর্তি পরীক্ষা শেষ করল। কি নিদারুণ এই পরীক্ষা পরীক্ষা খেলা! আমার সন্তান দিনরাত এক করে পড়াশোনা করে। তার পরিশ্রম আর দুশ্চিন্তা, এ সবকিছুর আড়ালে আমাদের প্রতি তার অভিমান—সেটা আমার সব সময় চোখে পড়েছে।

মুখে না বলেও যেন অনেক কিছু বলে সে। হয়তো বলছে, ‘মা, আর পারছি না। আর ইচ্ছা করছে না।’ কিন্তু আমি তো অসহায়। তাকে বলতে পারছি না, ‘এটাই শেষ; যা তুই এবার বইখাতা রেখে টিভি দেখ, খেলতে যা।’ পারিনি বলতে। উল্টো বকা দিয়েছি। সারা দিন পড়-পড়-পড় করেই চলেছি। আতঙ্কে থেকেছি। কি হবে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগ না পেলে! কি বলবে সবাই! না, অন্য কিচ্ছু নয়, ‘তুই পড়। তোকে পড়তেই হবে’, না হলে যে মান-সম্মান থাকবে না। হায়রে! কত কিছু ভেবে সন্তানকে সারা দিন বকেছি। কি হয়েছে তাতে? আমি আমার সন্তানের কাছে খারাপ হয়েছি, এই তো! এতে কারই-বা কি আসে যায়।

গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ৮৫ দশমিক ৯৫। প্রাপ্ত ফলাফলে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৮৭ দশমিক ৮৩, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬২ হাজার ৪২১ জন। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮১ দশমিক ৫৯ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। এ ছাড়া বরিশাল বোর্ডে পাসের হার ৮৬ দশমিক ৯৫ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭ হাজার ৩৮৬ জন। কুমিল্লা বোর্ডে পাসের হার ৯০ দশমিক ৭, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৪ হাজার ৯৯১ জন, দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ০৬, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১১ হাজার ৮৩০ জন। সিলেট বোর্ডে পাসের হার ৮১ দশমিক ৪০, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫৪ হাজার ৮৭১ জন। চট্টগ্রামে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৭৬, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১২ হাজার ৬৭০ জন। ময়মনসিংহে পাসের হার ৭৭ দশমিক ৩ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭ হাজার ১৭৯ জন। যশোরে পাসের হার ৮৩ দশমিক ৯, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৮ হাজার ৭০৬ জন।

আরও জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা) ‘ক’ ইউনিটে স্নাতক ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ ছিল। এবার ‘ক’ ইউনিটে মোট আসনসংখ্যা ১ হাজার ৮৫১টি। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ১ হাজার ৭৭৫টি, মানবিকের জন্য ৫১টি ও ব্যবসায় শিক্ষার জন্য ২৫টি। ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছেন ১১ হাজার ১০৯ জন। তাঁদের মধ্যে ১০ হাজার ৫৫৭ জন বিজ্ঞান বিভাগের, ৫৪২ জন মানবিক ও ১০ জন ব্যবসায় শিক্ষার। মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৬৩ জন। তাঁদের মধ্যে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫০ জন বিজ্ঞান বিভাগের, ৩ হাজার ৩৮০ জন মানবিক ও ৩৩৩ জন ব্যবসায় শিক্ষার। (ডেইলি স্টার, জুন ৫, ২০২৩)

আমাদের দেশের এ শিক্ষাব্যবস্থা একজন শিক্ষার্থীর চিন্তা, ভাবনা, ইচ্ছা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সব শেষ করে দিচ্ছে। একজন ছেলে বা মেয়ে যখন চিন্তা করে, ছোট থেকে স্বপ্ন দেখে চিকিৎসক হওয়ার। তখন তো সে শিশুটা তার সর্বস্ব দিয়েই চেষ্টা করে। এবং কেউ সফল হয়, কেউ হয় না—এটাই তো স্বাভাবিক।

যারা সফল, দেশের মানুষ তো তাদের দেশসেরাই মানেন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা ছেলে বা মেয়ে যখন তার ছোটবেলার স্বপ্নপূরণের সুযোগ পেয়ে যায়, তখন তাকে আবার অন্য জায়গায় কেন ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। আমি এটাই বুঝতে পারি না। তবে কি সে দ্বিধায় পড়ে যায়? সে কি পড়বে, নাকি নিজেকে আরেকবার মানুষের কাছে প্রমাণ করবে যে আমি সব জায়গায় সেরা। তবে কি আমাদের সন্তানদের লোকদেখানোর জন্য পড়াশোনা করাই! নাকি এটাই আমাদের সিস্টেম?

মনে করুন, একজন ছাত্র বা ছাত্রী তার আজন্মলালিত স্বপ্নপূরণের সুযোগ পেয়ে কোথাও ভর্তিযুদ্ধে টিকে গেল। সে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল। তখন দেখা গেল, তার কাছে মনে হলো, থাক, আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ব না, সবাই বলছে, প্রকৌশল পড়াই ভালো। তখন সে তার আজন্মলালিত স্বপ্ন ছেড়ে মানুষের কথায় একটা নতুন জীবন শুরু করল। এখানে তার এত দিনের ইচ্ছা বা সিদ্ধান্তর কোনো দাম নেই? এই ছেলে বা মেয়েটি ভবিষ্যতে তার জীবনের অন্য সিদ্ধান্ত কীভাবে নেবে? এর জন্য কে বা কারা দায়ী, ভাবুন তো?

আরও পড়ুন

হ্যাঁ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবচেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে যারা মেধাতালিকায় থাকে, তারাই সব জায়গায় শুরুতে থাকে। এটাই স্বাভাবিক কারণ। আমরা জানি ও মেনে নিই যে তারাই দেশসেরা। কিন্তু এক জায়গা ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়ার পর কেন সব জায়গায় পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করতে হয়, তারাই সেরা। হ্যাঁ, বলবেন তো বুয়েটে যদি অন্য সব জায়গার পরে পরীক্ষা হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা তো ঝুঁকি নিতে পারি না! হ্যাঁ, সত্যিই তো। কেন বুয়েটে সবার আগে পরীক্ষা হয় না? আমাদের দেশের সিস্টেমটা কেন এমন? কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তো এত আগে পরীক্ষা নেয় যে বাচ্চারা সেখানে পড়বে না জেনেও ভর্তি হয়ে যায়। কারণ, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা!

আরও পড়ুন

শুধু ভর্তি নিয়েই ক্ষান্ত হয় না, ক্লাস-পরীক্ষাও শুরু করে দেয় তারা। কিন্তু পরে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি বাতিল করে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তখন যে আসন শূন্য হয়, তখন কি করে সেই আসন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পূরণ করে? এভাবে আরেকজন শিক্ষার্থীর সুযোগ নষ্ট হচ্ছে। ক্লাস-পরীক্ষা শুরুর পরও আসন খালি হওয়া সাপেক্ষে আবার ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে আরেক জন শিক্ষার্থীকে নানান রকম নানা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির (ট্রমা) মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সেই ধাক্কা শুধু ওই শিক্ষার্থীই জানে। এ সবকিছুর জন্য শুধু আমাদের খামখেয়ালি দায়ী। একটা বা দুইটা পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করা যেতে পারে।আমার সন্তানের এ ভর্তিযুদ্ধে তার সঙ্গে সঙ্গে আমিও কত কিছু দেখলাম। বুয়েটে লিখিত পরীক্ষার দিন এক অভিভাবক জানাচ্ছেন, তার সন্তান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে চান্স পেয়েছে, এবং সে আইবিএতেই পড়বে।’ আমার প্রশ্ন ছিল, তবে কেন এই পরীক্ষা? অভিভাবকের উত্তর, ‘আমার সন্তান যে বুয়েটেও পড়ার যোগ্যতা রাখে, প্রমাণ করতে হবে না?’ এ কেমন প্রমাণ? কার কাছে প্রমাণ? বারবার কেন প্রমাণ? কিসের প্রমাণ? তবে কি আমরা সন্তানদের শুধু মানুষকে দেখানোর জন্যই পড়াশোনা করাচ্ছি?

হায় আমাদের শিক্ষা। ভর্তি পরীক্ষার সময় লক্ষ করলাম, আরেক অভিভাবক জানাচ্ছেন, ‘আমার সন্তান তো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা—সবখানে মেধাতালিকায় আছে। এখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকলেই হয়।’ আমার মনে হয় সব জায়গায় পড়ানোর সুযোগ থাকলে আমরা বাবা-মায়েরা তা-ই করতাম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াছড়ি, ‘আলহামদুলিল্লাহ....বুয়েটে ........তম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে

........তম; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ........তম; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে.....তম’ ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ লিখছে, ‘মা-বাবা বিশ্বাস করো, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারলাম না। হেরে গেলাম।’ এ কেমন হেরে যাওয়া? কার কাছে হেরে যাওয়া?

এ কি স্বপ্নপূরণ, না অসুস্থ এক প্রতিযোগিতায় নেমেছি আমরা সন্তানদের নিয়ে। দেশে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার জন্য যেমন একটাই পরীক্ষা দিতে হয়, আমার মনে হয়, প্রকৌশল ও অন্যান্য ভর্তি এক পরীক্ষার আওতায় আনা উচিত। সব বিশ্ববিদ্যালয় একসঙ্গে পরীক্ষা নেওয়া কি খুব কঠিন? বদলাতে হবে আমাদের সিস্টেম, বদলাতে হবে আমাদের মননকে।

  • লেখক: ইয়াসমিন হক রলি, ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী ও একজন অভিভাবক