আন্তর্জাতিক অণুজীব দিবস: কী কাজ করেন মাইক্রোবায়োলজিস্টরা
আন্তর্জাতিক অণুজীব দিবস গতকাল মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) পালিত হয়েছে। ২০২৪ সালের এ উপপাদ্য ‘Feed your Microbes’।
জীবাণু শব্দটা খুব ছোট থেকেই শুনে আসছি। ছোটবেলায় জ্বর-ঠান্ডা হলে যখন ডাক্তারের কাছে যেতাম, ডাক্তার বলতেন ভাইরাল ফিভার, এই ওষুধগুলো খেলে ঠিক হয়ে যাবে। প্রশ্ন করতাম, ভাইরাল বিষয়টা কী! ডাক্তার কাকু খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন, ভাইরাস হচ্ছে ছোট্ট একটি জীবাণু, যা কিনা দেখা যায় না, বোঝা যায় না কিন্তু আমাদের শরীরে জ্বর-ঠান্ডা হলে এদের উপস্থিতি বাড়ে। আবার এদের দ্বারাই রোগের টিকা তৈরি করা হয়। ভাইরাসের মতো আরও অনেক জীবাণু আছে, তাদের মধ্য ব্যাকটেরিয়া অন্যতম।
মুলত জীবাণু শব্দটা সেখান থেকেই হাতে খড়ি। জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করেনি, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। কারণ, জীবাণুই সব রোগ তৈরি করে, আবার সেই জীবাণু দিয়েই তৈরি করা হয় তাদের প্রতিষেধক। ১০০ ভাগের মধ্য মাত্র ৫ ভাগ জীবাণু আমাদের রোগ তৈরি করে। তার মানে হচ্ছে ভালো জীবাণুর সংখ্যাই বেশি। আর সেই সম্যাক জীবাণু নিয়েই মাইক্রোবায়োলজি সাবজেক্টটা পরিবেষ্টিত। জীবাণুর বেসিক বিষয় থেকে শুরু করে জীবাণুর চালচলন, গতিপথ, পরিবর্তন ধারা, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর গতিপথ এবং তাদের বিনাশকারী ক্ষমতার তথ্য-উপাত্ত এবং উপায় খুঁজে বের করা, রোগ সারানোর জন্য টিকা তৈরির পথ ইত্যাদি বহু জীবনভিত্তিক কাজ করে যাচ্ছেন অণুজীববিজ্ঞানীরা।
মনে পড়ে সেই দিনের কথা। ৮ মার্চ, ২০২০। করোনা সংক্রমণের খবর শুনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে পুরো জাতি। ধুলোয় মাখা হ্যান্ড স্যানিটাইজারগুলো যেন কী এক জাদুতে সব চকচক হয়ে উঠল দোকানগুলোতে। দুদিন যেতে না যেতেই সেগুলো আবার নাগালের বাইরে যেতে শুরু করল। কী এক আজব কারবার। সারা বছর যেখানে বেশির ভাগ মানুষকে মাস্ক পরানো যায়নি, সেখানে এক নিমেষেই দ্বিগুণ-তিন গুণ দাম দিয়ে কিনেও পরতে শুরু করল। এরপরের দিনগুলো যা হলো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
করোনাভাইরাস আমাদের কী শিক্ষা দিয়ে গেল। এবার সে বিষয়ে একটু স্মৃতি রোমন্থন করা যাক।
করোনা সংক্রমণ রোধে আমাদের বাইরে চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেল। ‘লকডাউন’ নামক শব্দটা আমাদের জীবনের ডিকশনারিতে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিল। বন্দী পাখির মতো জীবনের চলা শুরু হলো। সেটাও কি সবাই আমরা মেনেছি? চোর-পুলিশ খেলা তো আর কম খেলেনি। একবারও ভাবিনি লকডাউন মেনে চললে লাভ কার আর ক্ষতিই বা কার। এ খেলা আমাদের জীবনের সঙ্গেই খেলেছি। লকডাউনে লাভ-ক্ষতির হিসাব যা–ই হোক না কেন, ঘরমুখী করাতে আমাদের ঘরের মানুষদের সারা দিনের অক্লান্ত শ্রমের কিছুটা অংশীদারি অনেকেই হতে পেরেছি। আবার এর বিপরীতও অনেকের ঘটেছে। সংসারে অশান্তিও অনেকে নাকি বেড়ে গিয়েছেল। সে যা–ই হোক পিপিই পরে রাস্তায় বের হওয়া মানুষের সেই ছবিগুলো হয়তো স্মৃতির পাতায় লেখা রবে সারা জীবন। এমন সময় হয়তো আর না–ও আসতে পারে। তবে মাস্ক বা বারবার হাত ধৌত করাতে আমাদের যে অনেক রোগজীবাণুর আক্রমণ কমে গিয়েছিল, সেটা কিন্তু মানতেই হবে।
করোনায় সামাজিক অবক্ষয় তো চরম হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। করোনায় আক্রান্ত বাবা-মাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনা কিন্তু কম ঘটেনি। কোনো মা–বাবা তার সন্তানকে এমনভাবে দূরে ঢেলে দিতে পারতেন কি না, তা নিতান্তই খুঁজে পাওয়ার বিষয়। দুঃখের বিষয়, এই সামাজিক অবক্ষয়গুলো কিন্তু শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেশি ঘটেছে। আবার অনেক সন্তানই করোনার ভয়কে দূরে ঠেলে করোনায় আক্রান্ত মা–বাবার পাশে থেকেছে।
পথেঘাটে, চায়ের দোকানে, ঘরে-বাইরে সব সময় আলোচনা-সমালোচনা করেছি করোনার দিন কবে শেষ হবে, কবে আসবে সেই টিকা। দেশে–বিদেশে বিজ্ঞানীরা বসে বসে কি করছেন, এমন সমালোচনায় মুখর ছিল অনেকেই। অনেকেই আমরা আশাবাদী ছিলাম ২০২০ হচ্ছে করোনার, আর ২০২১ হবে ভ্যাকসিনের। বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশে–বিদেশে করোনা ভ্যাকসিনের অগ্রগতি ব্যাপকভাবেই দৃশ্যমান হলো। বাংলাদেশে সেই কাঙ্ক্ষিত ভ্যাকসিন এল। সেই থেকে শুরু হলো ভ্যাকসিন কি নেব নাকি নেব না—শুধু এই আলোচনা। কোনো ক্ষতিকারক দিক পাওয়া যাচ্ছে না জেনেও কেন এই চিন্তা, সেটা আজও অজানা। যাঁরা ভ্যাকসিন সম্পর্কে কোনোভাবেই কখনো অবগত ছিলেন না, তাঁদেরও দেখা গেছে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে সমালোচনা করতে। আবার যাঁরা ভ্যাকসিন নিচ্ছেন, তাঁদের অনেককেই দেখা গেছে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে। ভ্যাকসিন কি ১০০ ভাগ সুরক্ষা দেবে? কোথায় পেলেন এই গবেষণাতত্ত্ব! উওর জানা নেই। আর ভ্যাকসিন দেওয়ামাত্রই কি কাজ করবে! একটু তো সময় দেবেন, নাকি। মাস্ক, হাত ধোয়াসহ অনন্য স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। ধীরে ধীরে আবারও করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। রাষ্ট্র আমাদের বারবার এ বিষয়ে সতর্ক করছে। আর তাই আগামী দিনগুলোর দিকে আমাদের নজরদারি বাড়াতেই হবে। জীবন আমার-আপনার, আর এই সুন্দর জীবনকে সুরক্ষা করতে আমাদের সচেতন হতেই হবে। সর্বস্তরে সচেতন না হলে আমাদের আগামী প্রজন্মকে বারবার এই করোনা সমতুল্য সব ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস আমাদের গ্রাস করেই যাবে।
জাতির সব ক্রান্তিকালে জরুরি সেবা দিয়ে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মী, প্রশাসন, ব্যাংকার, সাংবাদিক, ওষুধ-খাদ্যসহ বিভিন্ন শিল্পের সঙ্গে জড়িত উৎপাদন-বিপণন কর্মকর্তারা। দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন ফার্মাসিস্ট-মাইক্রোবায়োলোজিস্ট কেমিস্টসহ অনেক নিবেদিতপ্রাণ। ওষুধশিল্পসহ ফুড-বেভারেজ প্রতিষ্ঠানে ফার্মাসিস্ট-কেমিস্টদের সঙ্গে মাইক্রোবায়োলজিস্টরা গুণগত মান নির্ণয় এবং নিশিচতকরণে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া অন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
দেশের এই ক্রান্তিকালে মাইক্রোবায়োলজিস্টদের ভূমিকা অপরিসীম। করোনার এই মহামারির সময়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে জীবন বাজি রেখে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন শত শত অণুজীববিজ্ঞানী। দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে পিসিআর মেশিন চালনাসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছের তাঁরা। ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরে মাইক্রোবায়োলজিস্টের ভূমিকা অপরিসীম। তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব, প্রোডাকশন, আর অ্যান্ড ডি, কিউএ, কিউসিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে।
কী কাজ করেন মাইক্রোবায়োলজিস্টরা
ওষুধ তৈরির মূল উপাদান হলো পানি। সেই পানি আসলেই ওষুধ তৈরি করার উপযুক্ত কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হয় নিয়মিত। কতগুলো ব্যাকটেরিয়া আছে, কোনো প্যাথজেনিক জীবাণু আছে কি না, সেটাও খুব ভালোভাবে দেখা হয়।
ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, সিরাপে কতগুলো ব্যাক্টেরিয়া–ছত্রাক আছে সেটা বাজারজাতকরণের আগে প্রতিটা ব্যাচ পরীক্ষা করে দেখা হয়। ইনজেকশন, চোখের ড্রপ, মলমে জীবাণু আছে কি না, এন্ডটক্সিন লিমিটের মধ্য আছে কি না, সেটাও প্রতিটা ব্যাচ পরীক্ষা করে দেখা হয়। এ ছাড়া ওষুধ বানানোর এরিয়াতে ধূলিকনার লিমিট, অপারেটরদের স্বাস্থ্যবিধি, ট্রেইনিংসহ সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে।
এমন কোনো শিক্ষার্থী গ্রুপ পাওয়া খুব দায়, যারা কিনা সরকারি চাকরি পেতে চায় না। সবাই চায় একটি স্থায়ী চাকরির সুবাদে জনগণের সেবা করতে। সেটা খুব স্বাভাবিক এবং এটাই হয়তো হওয়া উচিত। কিন্তু সরকারি চাকরির সংখ্যা তুলনায় কম হওয়ায় সবার চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই হয়তো সরকারি চাকরিকে সোনার হরিণ বলা হয়ে থাকে। সে যাহোক না কেন, তাহলে বাকিরা কোথায় যাবে? বিশেষ করে যারা বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু বিষয়ে (যেমন ফার্মাসিস্ট- মাইক্রোবায়োলোজিস্ট–বায়োকেমিস্ট-কেমিস্ট ইত্যাদি) অনেক অনেক পরিশ্রম করে তার অনার্স বা মাস্টার্স শেষ করছে! তাহলে তাদের সেকেন্ড চয়েস কি ফার্মাসিউটিকালস?
দেশের যেখানে ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে, সেখানে কেন সেকেন্ড চয়েস, সেটা নাহয় গবেষণা না–ই করলাম। তবে এখন পর্যন্ত যারা ফার্মা লিডার, তাদের অনেকেরই কিন্ত ফার্স্ট চয়েস ছিল ফার্মাসিউটিকালস, নয়তো কিভাবে রপ্তানির সিংহ ভাগ ওষুধ আর কেনইবা ৯৮ শতাংশ চাহিদা মেটাবে বাংলাদেশের অগণিত ফার্মাসিস্ট-মাইক্রোবায়োলোজিস্ট–বায়োকেমিস্ট-কেমিস্ট ইত্যাদি।
সম্ভাবনার অসীম দুয়ার খুলতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প। এ অবস্থায় লিডার তৈরি করা একদম বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। মনের জোরে হয়তো কোনোমতে চাকরি করা যায় কিন্তু মনোনিবেশ না থাকলে একজন আরঅ্যান্ডডি ফার্মাসিস্ট ঠিকঠাক নতুন প্রোডাক্টের ফর্মুলেশন করবেন কীভাবে R & D কেমিস্ট সঠিকভাবে সেই ফরমুলেশনের গুণাগুণ নির্ণয় করবেন, কীভাবে একজন প্রোডাকশন ফার্মাসিস্ট ভালো প্রোডাক্ট বানাবেন, কীভাবে একজন QA ফার্মাসিস্ট ওষুধের মান যাচাই করবেন আর কীভাবেই বা QC ফার্মাসিস্ট/কেমিস্ট অথবা একজন মাইক্রবায়োলজিস্ট ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ করবে।
পরিশেষে, সরকারি-বেসরকারিভাবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে ফার্মা সেক্টরে অণুজীববিজ্ঞানীদের ভূমিকা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য দরকার অনুপ্রেরণা, উৎসাহ আর মনোবল।
লেখক: মনোজিৎ কুমার রায়, মাইক্রোবায়োলজিস্ট