ভূমিকম্পের কাঁপুনি আমাদের দাঁড় করাল প্রস্তুতিশূন্যতার মুখোমুখি

ভূমিকম্প

একটা গ্রামে কতগুলো পরিবার থাকে সাধারণত? ছোট গ্রাম হলে ৬০ থেকে ৮০টি পরিবার থাকে। ঢাকা শহরে এমন অনেক ভবন আছে, একটি ভবনেই ছোট একটি গ্রামের চেয়ে বেশি মানুষ বাস করেন। গায়ে গা লেগে দাঁড়িয়ে থাকা কংক্রিটের জঙ্গলে যখন কোনো বিপর্যয় আসে, একসঙ্গে অনেক মানুষ আক্রান্ত হন। দেশের অন্য যেকোনো শহরের চেয়ে ঢাকায় এ অবস্থা সবচেয়ে বেশি করুণ। গতকালের ভূমিকম্পে এ বিষয়টি চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে এই শহরে বড় কোনো ভূমিকম্প হলে কতটা ক্ষতি হতে পারে।

গতকাল যে ভূমিকম্প অনুভূত হলো, তার স্থায়িত্ব খুব বেশি ছিল না; কিন্তু এতটুকুই যথেষ্ট ছিল গোটা নগরবাসীকে নিচে নামিয়ে আনতে। সেই কয়েক সেকেন্ডের আতঙ্ক আমাদের দাঁড় করিয়েছে বেশকিছু কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি। আমাদের সামনে উদোম করে দিয়েছে আমাদের দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা আর দায়িত্বহীনতার পিঠ। এ অবস্থা এক দিনে তৈরি হয়নি। আমরা এটিকে নিজেদের জন্য আপন করে নিয়েছি বহু বছরের চর্চায় আর অভ্যাসের মাধ্যমে। হয়তো এটি বাসা বেঁধেছে আমাদের রক্তে।

ভূমিকম্প

ঢাকা শহরে অনেক মানুষ আতঙ্কে লাফিয়ে নামতে গিয়ে আহত হয়েছে। নিহত ব্যক্তির সংখ্যা কমপক্ষে ১০ (সূত্র: প্রথম আলো)। স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম ভূমিকম্পে বাংলাদেশে প্রাণহানির ঘটনা দেখা গেল। শহরের নানা এলাকায় ভবন দুলেছে, কোথাও কোথাও হেলে পড়েছে। এসব দৃশ্য একটাই প্রশ্ন সামনে আনে—আমরা কি সত্যিই প্রস্তুত? এই ভূমিকম্পই যদি আর দশ সেকেন্ড স্থায়ী হতো, ঢাকা শহরের অবস্থা কী হতো?

বাংলাদেশ ভূমিকম্প–ঝুঁকিতে আছে—এটা নতুন কথা নয়। দেশের উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের চাপের ওপর দাঁড়িয়ে। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে শক্তিশালী ভূমিকম্পের সম্ভাবনাকে কখনোই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, অতীতের বড় ভূমিকম্পের পর দীর্ঘ বিরতি নতুন বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন, এ অঞ্চলের ভূগর্ভে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, যা কোনো একসময় বড় কম্পনে প্রকাশ পাবে। প্রশ্ন হলো, সেই দিনের জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত?

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

গতকালের ঘটনার পর যে দৃশ্যগুলো চোখে পড়েছে, সেখানে ভূমিকম্পের চেয়ে ভয়াবহ ছিল মানুষের বিপর্যস্ত আচরণ। আতঙ্কে ভবনের জানালা বা সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেশি। লিফট ব্যবহার করা, দুলতে থাকা বাড়ির ভেতরে দৌড়াদৌড়ি, ভিড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামা—এসবই আহত হওয়ার প্রধান কারণ। অর্থাৎ সচেতনতার অভাবই প্রাণহানি বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ হবে। দুর্যোগের মুহূর্তে সাধারণ মানুষ কী করবে, কোথায় দাঁড়াবে, কীভাবে নিরাপদে বের হবে—এসব মৌলিক জ্ঞান আমাদের সে রকম জানা নেই।

আরও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো কাঠামোগত দুর্বলতা। এই ভূমিকম্প ছিল মধ্যম মাত্রার, অথচ ঢাকার বহু ভবন দুলেছে, কোথাও কোথাও হেলে পড়েছে—এটাই বলে দেয়, আমাদের ভবনগুলো কতটা দুর্বলভাবে বানানো হয়েছে। বহু বছর ধরে নির্মাণ খাতে অসংগতি, মাননিয়ন্ত্রণে ঘাটতি এবং দায়িত্বহীনতার যে চক্র চলছে, তার ফল আমরা বোধহয় পেতে যাচ্ছি। ভবনের নকশা ও নির্মাণের প্রতিটি ধাপে মান বজায় রাখা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। উপকরণে ভেজাল, দক্ষ কারিগরের অভাব, পর্যাপ্ত তদারকির অভাব—সব মিলে মধ্যম মাত্রার কম্পনেও বড় ঝুঁকির আভাস দিচ্ছে।

দুর্বল ভবন যখন ঘনবসতির ওপর দাঁড়ায়, তখন বিপদ বহুগুণ বাড়ে। বিশেষ করে ঢাকার মতো উচ্চ ঘনত্বের শহরে ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকাজই হয়ে পড়বে প্রধান চ্যালেঞ্জ। সরু রাস্তা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ সম্প্রসারণ—সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজ পরিচালনা করা কঠিন হয়ে যাবে। ভূমিকম্পের ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিও সমান প্রবল। একমুহূর্তের কাঁপুনি যদি গ্যাসলাইন, বিদ্যুৎ–সংযোগ বা পানির পাইপে বড় ধরনের ক্ষতি করে, তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। ভূমিকম্প পরবর্তী আগুন নেভানোই কঠিন একটি কাজ হয়ে দাঁড়াবে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

যে সমস্যাটি বারবার সামনে আসছে, তা হলো আমাদের দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব। ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে বড় বড় গবেষণা হয়েছে, বিপর্যয়ের সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, ভবন ধস ও প্রাণহানি কত হতে পারে, তার হিসাবও বহুবার এসেছে; কিন্তু সেসব রিপোর্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে বাস্তব প্রস্তুতি নেওয়ার দিকে অগ্রগতি খুবই কম। বহু ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এখনো শনাক্ত হয়নি আর শনাক্ত হওয়া ভবনে সংস্কার–রেট্রোফিটিংয়ের কাজ তো আরও অনেক দূরের কথা। নগর–পরিকল্পনায় ভূমিকম্পঝুঁকি এখনো মূল বিবেচনার জায়গা পায়নি। আমাদের এখানে যেকোনো ভবনে আগুন লাগলে বা কোনো দুর্ঘটনায় পড়লেই কেবল শোনা যায় এই ভবনের অনুমোদন ছিল না, এটি অপরিকল্পিত ইত্যাদি অজুহাত।

জনগণের সচেতনতার অভাব যেমন বিপজ্জনক, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতির অভাব আরও ভয়ংকর। জরুরি সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম ও সমন্বয়—সব ক্ষেত্রেই বড় ঘাটতি রয়েছে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকাজে সময় লাগবে এবং সেই সময়টাই প্রাণহানির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা অফিস ভবনগুলোতে নিয়মিত মহড়ার কোনো সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি।

বাংলাদেশের মতো দেশকে ভূমিকম্পপ্রস্তুতি শুরু করতে হবে তিনটি স্তরে—ব্যক্তি, ভবনকাঠামো ও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি; ভবনের ক্ষেত্রে মাননিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা এবং পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা প্রয়োজন; আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি, সমন্বিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা। এতে নগরঘনত্ব কমানো থেকে শুরু করে জরুরি উদ্ধারপথ নিশ্চিত করা পর্যন্ত সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

গতকালের ভূমিকম্প ছিল একটি সতর্কবার্তা, একটি সুযোগও বটে। প্রতিবার কম্পন থেমে গেলে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি; কিন্তু ভূগর্ভের সঞ্চিত শক্তি কোনো দিনই স্থির থাকে না। বিপর্যয় প্রতিরোধের জন্য দরকার আজ থেকেই সঠিক সিদ্ধান্ত, শক্তিশালী নীতি, সঠিক বাস্তবায়ন ও জনগণের সচেতনতা।

ভূমিকম্প ঠেকানো সম্ভব নয়; কিন্তু ক্ষতি কমানো সম্ভব। আর সেই কাজ আগে শুরু করলে বাঁচবে জীবন, টিকে থাকবে শহর।

*লেখক: সৈয়দ মিজানূর রহমান: সংগীত শিল্পী