ঈদে বাড়ি ফেরা

প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত দিয়ে দেখি ওয়ালেট নেই! সামনের পকেটে হাত দিয়ে দেখি মুঠোফোন নেই! তার মানে ভিড়ের মধ্যে তেলেসমাতি হয়েছে! ঈদের বাজারে কেউ একজন দক্ষতার সঙ্গে কাজটা করেছে।

ঈদের কেনাকাটা করার জন্য বাবা পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। বিকাশ থেকে ক্যাশ আউট করতে না করতেই কেউ মেরে দিয়েছে! টাকা-মুঠোফোন হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি ফুটপাতের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকি! চোখ ছলছল করে। অনলাইনে ক্লাস করার জন্য বাবা অনেক কষ্ট করে একটা ভালো ফোন কিনে দিয়েছিলেন!

গত ঈদে এভাবে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছিলাম। বাড়ি যাওয়ার টাকা পর্যন্ত ছিল না। সে জন্য এবার খুব সাবধানে চলাফেরা করছি। জীবনের প্রথম ইনকাম পকেটে! তাই পকেটটা শক্ত করে ধরে শোরুমে শোরুমে ঘুরছি। পকেটে যে খুব বেশি টাকা আছে, তা নয়; কিন্তু এর মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি। রোজার মধ্যে সারা মাস টিউশনি করে গতকালই হাতে পেয়েছি চকচকে কয়েকটা এক হাজার টাকার নোট।

এখন চলছে ঈদের বাজার, গতবারের মতো কখন কে তেলেসমাতি দেখায় বলা তো যায় না, তাই বেশ সাবধানে ঘুরছি। মায়ের জন্য একটা সুন্দর শাড়ি এবং বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনব। কিন্তু পছন্দ আর পকেট সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় সময় গড়িয়ে যাচ্ছে।

এবারের ঈদ আমার কাছে একটু ভিন্ন। আমি এখন দেশের সবচেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র। একটা অদ্ভুত ভাব আমার মধ্যে কাজ করে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী বলে কথা! তা ছাড়া ঈদের সেলামিটা হেব্বি পাব।

অবশেষে একটা পাঞ্জাবি ও একটা শাড়ি কিনি। তারপর নিজের জন্য টুকটাক কেনাকাটা করে কমলাপুরের বাস ধরি। সকালে বাসা থেকে একবারে বের হয়েছি, কেনাকাটা শেষ করে সন্ধ্যার ট্রেনে বাড়ি যাব।

পড়ন্ত বিকেল, রাস্তায় অসহনীয় জ্যাম আর গরমে রোজা ধরে এসেছে। বাস কমলাপুরে আসতেই মাগরিবের আজানের শব্দ কানে আসে, চারদিকে ইফতারে জন্য হুলুস্থুল শুরু হয়। আমিও ছোলা-মুড়ি-খেজুর কিনে ইফতার শেষ করি। তারপর টাকার হিসাব করি, যে টাকা আছে তাতে বাড়ি যেতে সমস্যা হবে না।

মা-বাবা চিন্তা করবেন, তাই তাঁদের বলেছি, পাঁচটার ট্রেনের টিকিট করেছি। ভেবেছিলাম স্টেশনে টিকিট কেটে নেব। কিন্তু কাউন্টারে মানুষের ভিড় দেখে আমার চোখ চড়কগাছ! এত ভিড়ের মধ্যে টিকিট কাটব কীভাবে, ট্রেনে উঠব কীভাবে?

স্টেশনের দোকান থেকে এক বোতল পানি কিনে সাবধানে ব্যাকপ্যাকের এক কোনায় রাখি, যেন শাড়ি বা পাঞ্জাবিতে পানি না লাগে। অতঃপর বসে বসে দেখছি একটার পর একটা ট্রেন চলে যাচ্ছে কিন্তু ভেতরে, বাইরে এমনকি ছাদে তিল ধারণের জায়গা নেই।
অবাক হয়ে দেখি স্টেশনে কিছু লোক কাঁধে মই নিয়ে ঘুরছেন। এখানে মইয়ের কাজ কী? পরে দেখি এসব মই বেয়ে লোকজন ট্রেনের ছাদে উঠছে। বিনিময়ে মইওয়ালাকে মাথাপিছু ১০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ, দারুণ ব্যাপার।

আমি উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনের খোঁজ করতে থাকি। ১০ টাকার বিনিময়ে ছাদে উঠতে পারলেই বাড়ি নিশ্চিত। শুধু একটু রিস্ক আর মানসম্মানের ভয় আছে, এই যা! সে যা-ই হোক, রাতে তো কেউ আমাকে দেখবে না, চিনতেও পারবে না। আর রিস্ক তো সব জায়গায় আছে। রাত ১১টার সময় ১০ টাকার বিনিময়ে মই বেয়ে ট্রেনের ছাদে উঠি।
আমার উচ্চতা ভীতি আছে। ট্রেনের ছাদ থেকে নিচে তাকাতেই ভয়ে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে, এ আমি কোথায় উঠেছি! ট্রেন যখন চলতে শুরু করে তখন প্রচণ্ড বাতাস, ধুলা আর ঝাঁকুনিতে আমার দেহ থেকে প্রাণ বের হওয়ার উপক্রম হয়। মনে হয় কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে!

তারপর ট্রেন বিমানবন্দর স্টেশনে থামে। আমি সিদ্ধান্ত নিই, বাড়িতে যাওয়া হোক আর না হোক ট্রেনের ছাদে আর না। কিন্তু নামব কীভাবে, এখানে মইওয়ালারা নেই। পুলিশ মইওয়ালাদের পিটিয়ে স্টেশন থেকে বের করে দিয়েছে। পরে পুলিশের সহযোগিতায় ছাদ থেকে ভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ি। এবারের মতো বেঁচে গেলাম, ধরে প্রাণ ফিরে আসে।

বিমানবন্দর স্টেশনেও টিকিটের জন্য লম্বা লাইন। অনেক কষ্টে একটা উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনের সিট ছাড়া টিকিট কিনে অপেক্ষা করতে থাকি। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, মানুষের কোলাহল কিছুটা কমে আসছে। আমি স্টেশনের এক কোনায় বসে আছি। অসহায় পেয়ে মশার দল আমাকে ইচ্ছামতো খাচ্ছে, রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। মুঠোফোনে চার্জ নেই, বন্ধ হয়ে গেছে। ঘুমঘুম চোখে ব্যাকপ্যাক শক্ত করে ধরে রাখি, কেউ যেন আমার গুপ্তধন চুরি করতে না পারে। রাত দুটার দিকে অনেকটা লড়াই করে ট্রেনে উঠি। নিশুতি রাতে ছুটে চলে ট্রেন।

ভোর সোয়া ৪টার সময় শহীদ মনসুর আলী স্টেশনে ট্রেন থামে। প্ল্যাটফর্মে পা রাখতেই ফজরের আজান ভেসে আসে। স্টেশনের গেট দিয়ে বের হতেই দেখি বাবা অপলকভাবে যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি দৌড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। আমার মনে পড়ে, বাবার রাত ১০টার সময় স্টেশনে আসার কথা। তার মানে, বাবা সেই সময় থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। নিশ্চয়ই তিনি একটুও ঘুমাননি। শেষ রাতের খাবারও খাননি!

**রূপক রেজা, মিরপুর, ঢাকা

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]