এবারের গণবিস্ফোরণের পটভূমি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ঢাকা, ৩ আগস্টছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

এমনিতেই সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর খ্যাপা। তার মধ্যে ভরা মৌসুমে আলুর কেজি ৬০ টাকা, পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা, যা একেবারে অগ্রহণযোগ্য! এমন সময় এক তরুণ দেড় মিলিয়ন টাকা দিয়ে একটা ছাগল কিনে হইচই ফেলে দেন। সবাই যোগ–বিয়োগ করে, কিন্তু হিসাব মিলাতে পারে না। কীভাবে একটি ছাগলের দাম ১৫ লাখ টাকা হয়! জেন–জি খুঁজে বের করে ক্রেতার অবৈধ আয়ের খুঁটিনাটি। এই তরুণ এনবিআরের এক কর্মকর্তার ছেলে। একজন সরকারি কর্মকতার এত টাকা!
এদিকে সরকারি দলের এক সংসদ সদস্য ভারতে খুন হন। তদন্তে বের হয়ে আসে, ওই সংসদ সদস্য দীর্ঘদিন ধরে সোনা চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত। চারদিকে নিন্দার ঝড় ওঠে!

এরপর সামনে আসে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির ফিরিস্তি। আলাদিনের চেরাগও যেন হার মেনে যায়। সরকারের সুবিধাভোগীদের দুর্নীতির খোঁজখবর নিয়ে দেখা যায়, শত শত কোটির নিচে কেউ কারবার করে না। এর মধ্যে দৃশ্যপটে আসেন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ। এই যখন অবস্থা, তখন কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে তোলে! ২০১৮ সালে যে কোটাব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল, এখন হাইকোর্ট সেটা বহাল রেখেছেন। শুরু হয় ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ। এর মধ্যে পেনশন ইস্যু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কর্মবিরতিতে যান! এ ছাড়া রপ্তানি আয়ের হিসাবে গরমিল, ব্যাংকিং খাতে সীমাহীন অনিয়ম, ভারতকে ট্রেন সুবিধা দেওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আস্তে আস্তে সবকিছু একবিন্দুতে মিলে যায়।

ছাত্ররা কোটা নিয়ে যখন বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন শুরু করেন, তখন তাঁদের এক ছাতার নিচে নিয়ে আসে পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবরও। ছাত্রছাত্রীরা আরো ক্ষুব্ধ হন, আন্দোলনের বেগ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এর মধ্যে সদ্য পদত্যাগ করা শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে এসে ঘটনার প্রেক্ষাপটে ছাত্রছাত্রীদের রাজাকার বলে গালি দেন। এটা যতটা না গালি, তার চেয়ে বেশি ছিল তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য। তাত্ক্ষণিকভাবে এর প্রতিক্রিয়া দেখান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। রাতেই সব শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসেন এবং নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দিতে থাকেন। শেখ হাসিনাকে সরাসরি স্বৈরশাসক বলেন শিক্ষার্থীরা, যা ছিল নজিরবিহীন! একই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা সাবলীলভাবে বলেন, ‘আমার পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে; সে হেলিকপ্টারে চলাফেরা করে!’ এ কথা অনেকটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো হয়ে যায়। এর মধ্যে যখন প্রধানমন্ত্রী নিজের মুখে দুর্নীতির এ রকম স্বীকারোক্তি দেন, তখন এটা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে। সাধারণ মানুষ রাগে ফুঁসতে থাকে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল, কিন্তু সরকার এদের আর এগোতে দিতে চায় না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের দমন করার জন্য লেলিয়ে দেন ছাত্রলীগকে। এতে শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা প্রচুর মার খান, তবে হামলা প্রতিহত করেন। বিপুল পরিমাণ নারী শিক্ষার্থীর মিছিলে–স্লোগানে প্রকম্পিত হয় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের এমন প্রতিরোধ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আরও উজ্জীবিত করে। আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায় সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজে, এমনকি স্কুলে।

সরকার এবার পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সতর্ক করে দেওয়া হয়, ‘বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না।’ এতে কেউ ভয় পান না, সব প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। একপর্যায়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। নিরস্ত্র আবু সাঈদের এ হত্যাকাণ্ডে ক্রোধ ছড়িয়ে পড়ে সমাজের সর্বস্তরে।

অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হল ছেড়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীরা নির্দেশ অমান্য করলে তাঁদের পিটিয়ে হলছাড়া করা হয়। এ আন্দোলনের বৃহৎ অংশ মেয়েরা, হল বন্ধ হলে তাঁরা চলে যেতে বাধ্য হন। লোকবলের অভাবে স্তিমিত হয়ে আসে আন্দোলনের বেগ। কোণঠাসা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন জায়গায় রাত্রিযাপন করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান।

এমন অবস্থায় আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো ছাত্রছাত্রী। তাঁরা ডুবতে থাকা জাহাজকে তীরে নিয়ে আসেন। পাল্টে যায় দৃশ্যপট। স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা ইউনিফর্ম পরে আন্দোলনে যোগ দেন। রক্তে রঞ্জিত রাজপথে রচিত হয় গণ–অভ্যুত্থানের পটভূমি! তারপর ইতিহাস!

লেখক: রূপক, মিরপুর, ঢাকা