মৃত্যু-অমৃত করে দান

আহমেদ রুবেল

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভৈরবী কীর্তন রাগে যখন গেয়ে ওঠেন...
‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
রক্তকমলকর, রক্ত-অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান॥’

গানটি বরাবর চিরায়ত সত্যি বলেই প্রতিভাত হয়।

গতকাল সকালেই কে জানত এই ভূমির জাত শিল্পী ও পূর্ণতায় ভাস্বর অভিনেতা আহমেদ রুবেলের জীবনেও মৃত্যু এমন আচমকা অমৃত দান করে যাবে!

৮ বছর পর মুক্তি পেতে যাচ্ছে বহু পরিশ্রমে গড়া ‘পেয়ারার সুবাস’ চলচ্চিত্র। আর কিছুক্ষণ পরই নিজ চোখে দেখবেন নিজেরই কৃতকর্ম। কিন্তু তা হলো না। মুভি হল থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বে থাকতেই হায়াতের বিধিলিপি থামিয়ে দিল প্রাণপ্রবাহ। তবে আহমেদ রুবেল নামের এই নিপুণ অভিনেতা ঠিকই জ্বালিয়ে রাখলেন তাঁর অতুল্য কর্মপ্রদীপ।

১৯৬৮ সালের ৩ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রাজারামপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া আহমেদ রুবেল বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। অভিনয়ের সঙ্গে তাঁর সখ্য মঞ্চ দিয়ে। সেলিম আল দীনের ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেওয়ার পর ‘হাতহদাই’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন রুবেল। তাঁকে প্রথম টিভি নাটকে পাওয়া যায় একুশে টেলিভিশনের পর্দায় গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নযাত্রা’য়। তারপর হুমায়ূন আহমেদের ঈদনাটক ‘পোকা’য় অভিনয় করেন রুবেল, তৈরি হয় তাঁর আলাদা ধরনের জনপ্রিয়তা।

হুমায়ূন আহমেদের ‘অতিথি’, ‘নীল তোয়ালে’, ‘বিশেষ ঘোষণা’, ‘সবাই গেছে বনে’, ‘বৃক্ষমানব’, ‘যমুনার জল দেখতে কালো’ নাটকে রুবেলের অভিনয় প্রশংসিত হয়। মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা ধারাবাহিক ‘প্রেত’ নাটকটি রুবেলকে দেয় অন্যরকম জনপ্রিয়তা। হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়ায়’ অভিনয় করে দারুণ সুনাম কুড়ান।

১৯৯৪ সালে বাণিজ্যিক ধারার ‘আখেরি হামলা’ সিনেমা দিয়ে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। এ পর্যন্ত ‘চন্দ্রকথা’, ‘আজকের ফয়সালা’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’, ‘রঙিন রংবাজ’, ‘কে অপরাধী’, ‘সাবাস বাঙালি’, ‘মেঘলা আকাশ’, ‘পৌষ মাসের পিরিত’সহ বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করেছেন রুবেল। ‘ব্যাচেলর’, মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘গেরিলা’, ‘দ্য লাস্ট ঠাকুর’, ‘অলাতচক্র’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ ও সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘চিরঞ্জীব মুজিব’ তাঁকে একজন দারুণ অভিনেতা হিসেবে বারবার তুলে ধরেছে। কলকাতার সিনেমাতেও রুবেল কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে ভারতের নির্মাতা সঞ্জয় নাগ পরিচালিত ‘পারাপার’-এ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

হুমায়ূন আহমেদের ‘পোকা’ নাটকের ‘ঘোড়া মজিদ’ চরিত্রটি এখনো আমাদের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। তাঁর দরাজ কণ্ঠস্বর ছিল অসাধারণ ও অদ্বিতীয়। নিবিষ্ট এ অভিনেতা বাবা প্রফেসর আয়েশ উদ্দিনের সঙ্গে গাজীপুরে থাকতেন। আয়েশ স্যার গাজীপুরের অন্যতম আলোকিত ব্যক্তিত্ব। গাজীপুরই হলো তাঁর চিরস্থায়ী ঠিকানা।

ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনায় নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন রচিত এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু নির্দেশিত কিত্তনখোলা, হাতহদাই, যৈবতী কন্যার মন ও বনপাংশুলে আহমেদ রুবেলের অভিনয় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। এমন এক অভিনেতার অকালে চলে যাওয়ায় আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হলো। মহাকাল আর কবে এই শূন্যতা পূরণ করতে পারবে কে জানে।

আমরা একজন নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীর পুণ্য স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।