দর্শনা-গেদে স্থল বন্দর : স্বস্তিদায়ক ভ্রমণের সঙ্গে এখন ব্যবসা-বাণিজ্য নজর দিতে হবে
দর্শনা চুয়াডাঙ্গা জেলার ভারত সীমান্তবর্তী গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। দেশের প্রথম রেললাইন ও বৃহত্তম চিনি কল কারখানা এখানে অবস্থিত। দর্শনার জয়নগর নামক স্থানে স্থল বন্দর নির্মান কাজ প্রক্রিয়াধীন। এই বর্ডার ব্যবহার করে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত করে। করোনার কারণে প্রায় ৩ বছর বন্ধ ছিল দর্শনা-গেদে বন্দরের ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। দুই দেশের মানুষের দাবির কারণে এই বছরের ২ মার্চ থেকে আবার চালু হয় চেকপোস্টটি।
গেদে, পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ট্রানজিট পয়েন্ট ও চেকপোস্ট। ১৮৬২ সালে এখানে রেল স্টেশন নির্মিত হয়। শিয়ালদহ-গেদে রেল পথ ব্যবহার করে দুই দেশের মানুষ কলকাতা সহ পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। দেশ ভাগের আগে কলকাতা থেকে গেদে-দর্শনা রেলপথ ব্যবহার করে সরাসরি গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করতো। দীর্ঘ সময় পরে ২০০৮ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু হয়।
গত বছর প্রথম বারের মতো কলকাতা যাওয়ার পথে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে করোনার কারনে অন্য পোর্টগুলো বন্ধ বা সীমিত চালু থাকায় বেনাপোল স্থল বন্দর দিয়ে রোদ, গরম ও বৃষ্টিতে ভিজে কয়েক ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে দুই দেশের ইমিগ্রেশন শেষ করি। এরপর কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর বনগাঁ স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে রওনা হয় কলকাতা শহরের উদ্দেশ্য। বেনাপোল দেশের বৃহত্তম স্থল বন্দর হওয়ায় এখানে সবসময় যাত্রীদের চাপ বেশি থাকে। কিন্তু গত সপ্তাহে কলকাতা যাবার অভিজ্ঞতা ছিল একদমই আলাদা। দর্শনা-গেদে বন্দর আমাদের বাড়ি থেকে সড়ক পথে ১ ঘন্টার পথ। ইমিগ্রেশনে তেমন ভীড় না থাকায় কয়েক মিনিটে সব কাজ শেষ করে রওনা হয় ভারতের গেদে ইমিগ্রেশনের দিকে। দর্শনা বর্ডার থেকে ১ কিলোমিটারের কম পথ গেদে ইমিগ্রেশন। ভ্যানে বা পায়ে হেটে যাওয়া সম্ভব। এক পাশে রেলপথ অন্য পাশে সবুজ ফসলের মাঠ। গেদে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে আরো অল্প সময় লাগে কিন্তু ট্রেনের সময়সূচি না জানা থাকায় বেশ কিছু সময় অপেক্ষার পর ট্রেন ধরে তিন ঘন্টার কম সময়ে কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে যায়। খুব অল্প খরচে এই পথ ব্যবহার করে যাতায়াত করা সম্ভব। ঝিনাইদহ, বৃহত্তর কুষ্টিয়া এবং রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের মানুষ পশ্চিমবঙ্গে যাতায়াতে সাধারণ এই বন্দরটি ব্যবহার করে। ইমিগ্রেশনে ভোগান্তি ছাড়া কম খরচে কলকাতা যাতায়াতে এই পথটি বেশ সুবিধাজনক। গেদের ইমিগ্রেশনের সাথেই রেল স্টেশন। ফলে একটা বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। তবে, দর্শনা শহর থেকে বর্ডার এবং বর্ডার থেকে গেদে ইমিগ্রেশন যাওয়া পথে ভাড়া সরকারি ভাবে নির্ধারণ করে দিলে খরচ আরো কম হবে। যাত্রীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে দুই দেশের ইমিগ্রেশন পয়েন্টে আরো সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
যাত্রী পরিসেবার সাথে দুই দেশের ব্যবসা বানিজ্যের উন্নয়নে এই বন্দরটি উত্তম একটি মাধ্যম হতে পারে। এখানে (দর্শনা-গেদে) এবং পাশের উপজেলা জীবননগরের দৌলতগঞ্জ-মাইজদিয়া'য় পূর্ণাঙ্গ স্থল বন্দর নির্মান প্রক্রিয়াধীন। দিনে দিনে দুই দেশের ব্যবসা বানিজ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও ভ্রমন বৃদ্ধি পাওয়ায় পাশ্ববর্তী জেলা যশোরের বেনাপোল স্থল বন্দরের উপর বেশি চাপ পড়ছে। এখানে এখন অবকাঠামো উন্নয়ন করে ক্ষুদ্র থেকে ভারি শিল্প কারখানা তৈরি করতে হবে। দুই দেশের বানিজ্য ঘাটতি কমাতে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। পদ্মা সেতু চালু হলে এই পথ ব্যবহার করে দুই দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহন করা সম্ভব হবে অতি দ্রুত সময়ে। যশোর থেকে মহেশপুর, জীবননগর ও দর্শনা হয়ে মুজিবনগর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মান করবে সরকার। ফলে, দৌলতগঞ্জ-মাইজদিয়া বর্ডার দিয়ে পণ্য আমদানি রপ্তানিতে এই রেলপথ ব্যবহার করা যাবে। উত্তর বঙ্গের সাথে বেনাপোল, ভোমরা ও মংলা বন্দরের সড়ক পথের যোগাযোগ উন্নয়নে সরকার ৬ লেনের সড়ক নির্মান করছে। এখন, দর্শনা ও জীবননগর হয়ে কালিগঞ্জ পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত করলে এই রুট ব্যবহার করা সাথে সড়ক পথেই যশোর ও পদ্মা সেতুর হয়ে ঢাকাসহ অন্য অনেক আঞ্চলে পণ্য সামগ্রি দ্রুত সময়ে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এই দুই বর্ডার থেকে কলকাতার দূরত্ব তুলনামূলক কম হওয়ায় পণ্য পরিবহনের খরচ ও সময় দুইটাই কমে যাবে। সরকারি ও বেসরকারি ভাবে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মেহেরপুরে কৃষি পণ্য উৎপাদন কারখানা ও শিল্প-কলকারখানা নির্মান এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে বানিজ্যের সমতা আনা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। বৃটিশ আমলে এই অঞ্চলের উৎপাদিত সবজি ট্রেনে করে কলকাতা বাজারে সরবরাহ করা হতো। ফলে, এই দুই বন্দর ব্যবসা বানিজ্যের উন্নয়নে সাথে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও সংস্কৃতি বিনিময়ে কাজ করবে। ভিসা ফ্রি যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হলে বানিজ্য ও পর্যটন শিল্পের আরো বিকাশ ঘটবে। দেশের পর্যেটন স্পটগুলোতে বিদেশিদের আগমন বৃদ্ধি পাবে এতে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়া যাবে। সরকারের সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক, মো. শাহিন রেজা, সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।