সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার আশঙ্কা
গত বছর জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় ভয়াবহ বন্যা হয়। ভারী বর্ষণের সঙ্গে উজানের ঢল নেমে বন্যা অনেক দিন স্থায়ী হয়। নদীর পানি ও ঢলের পানিতে চারদিক প্লাবিত হয়ে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। এ অবস্থায় বৃষ্টি ও বজ্রপাত উপেক্ষা করে মানুষ ছুটে গিয়েছিলেন আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে, কেউ উঁচু ভবন কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। এক দফায় নয়, দুই দফায় বন্যা হয় সেবার। প্রথমবার বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয়বার বন্যা হয়। জনগণের চরম ভোগান্তির পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যার ধকল কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছে। তবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত থাকায় কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছিল।
পরপর দুই দফা বন্যার ভয়াবহতা মানুষ এখনো ভুলতে পারেনি। সে বছর হঠাৎ করে এক দিনের কয়েক ঘণ্টার টানা বর্ষণে সিলেট ও সুনামগঞ্জের যাতায়াতের রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। মানুষের চলাচলে দুর্ভোগ নেমে আসে। সিলেটের সঙ্গে সুনামগঞ্জের যোগাযোগব্যবস্থা কয়েক দিন বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট–সেবাও ব্যাহত হয়েছিল। সুনামগঞ্জের মানুষ কয়েক দিন বিদ্যুৎহীন অবস্থায় অন্ধকারে ছিল। মানুষের গরু, হাঁস, মুরগিসহ অনেক গৃহপালিত পশু বন্যার পানিতে ভেসে গিয়েছিল। সবকারি হিসাবে এ বন্যায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘরের আসবাব, গোলার ধান, মাছের খামার, গবাদি পশু ভেসে যায়। রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
এ বছর টানা কয়েক দিন জ্যৈষ্ঠের খরতাপে পুড়েছে সারা দেশ। প্রচণ্ড গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। কয়েক দিন যাবৎ স্বস্তির বৃষ্টি হলেও ১৪ জুন সিলেটে সকাল থেকে টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টি হয়। এতে সিলেট শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। অনেক স্থান হাঁটুপানিতে তলিয়ে যায়। শহরের চলাচলের রাস্তাসহ বিভিন্ন বিপণিবিতানে বৃষ্টির পানি ঢুকে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে। ১৪ জুন থেকে প্রতিদিনই বর্ষণ হচ্ছে। উজানের ঢলে নেমে আসা পানি এবং বৃষ্টিতে নদীর পানি বাড়ছে।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রমতে, ১৩ জুন ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, একই দিনে সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি ৯১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া ভারতের মেঘালয়ে অতিবৃষ্টির কারণে উজান থেকে ঢল নেমে আসছে। এর ফলে সীমান্তবর্তী এলাকার সুরমা, কুশিয়ারা, রক্তি, কালনী, ধোপাজান ও জাদুকাটা নদ–নদী দিয়ে বিভিন্ন হাওরে ঢলের পানি প্রবেশ করছে। তাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুর সড়কের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা ইতিমধ্যে প্লাবিত হয়েছে।
এতে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাউবো সূত্রে জানা যায়, পানি বাড়া অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ১৩ জুন সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। পরদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১৫১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। ১৮ জুন সিলেটের কানাইঘাট ও সুনামগঞ্জের ছাতকে সুরমা নদীর পানি কিছুটা বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে নিম্নাঞ্চল কিছুটা প্লাবিত হয়েছে। সিলেট পাউবো জানায়, সুরমা নদীর কানাইঘাটে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। ১৭ জুন সন্ধ্যায় ছিল ১২ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার। সিলেট পয়েন্টে একই দিনে ৯ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে, যেখানে সিলেটে বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ১৩ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার। সেখানে একই দিনে ছিল ১১ দশমিক ১০ সেন্টিমিটার।
প্রতিদিনের বৃষ্টি এবং উজানের ঢলে নেমে আসা পানি দেখে মানুষের মধ্যে শঙ্কা কাজ করছে। ২০২২ সালেও এভাবেই অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ এবং সিলেট পানির নিচে নিমজ্জিত হয়। সেই শঙ্কা থেকে এখন নদ-নদীর পানি বাড়া দেখে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। বর্তমানে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী পানিতে টইটুম্বর হয়ে আছে। এ ছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বিভিন্ন হাওর পানিতে তলিয়ে গেছে। এর ফলে যেকোনো সময় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা টানা ভারী বর্ষণ হওয়ায় বন্যা হওয়ার আশঙ্কা আরও প্রবল হচ্ছে।
বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন বাঁধ নির্মাণ করায় পানিনিষ্কাশন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। পাশাপাশি শহরের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা এবং ছোট ছোট খাল বা ছড়াগুলো দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীতীর ভেঙে যাওয়া ও নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির স্বাভাবিক গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হয়। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তলদেশ অনেকাংশে ভরাট হয়ে গেছে। নদীর বিভিন্ন অংশ দখল হয়ে জনবসতি কিংবা দোকানপাট গড়ে উঠেছে। এর ফলে নদীর আয়তন কমে পানির ধারণক্ষমতা কমে আসছে। এর ফলে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তবে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় আগে থেকেই কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বন্যার সময় পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। পয়োবর্জ্য ও বন্যার পানি একাকার হয়ে রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে। এ ছাড়া বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দেয়। এর ফলে আমাশয়, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, জন্ডিসের মতো পানিবাহিত রোগবালাই বাড়তে থাকে। ঠান্ডাজনিত এবং মশা–মাছির উপদ্রবে শিশুদের সর্দি, জ্বর, কাশি বেড়ে যায়। সে জন্য ওরস্যালাইন এবং পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট রাখা জরুরি। প্রয়োজনে শুকনা খাবার যতটুকু সম্ভব, সঙ্গে রাখতে হবে। বন্যার আগাম প্রস্তুতির জন্য ঘরে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুখাদ্যের ব্যবস্থা ও গবাদিপশুর খাদ্য সংরক্ষণ করে রাখা জরুরি। এ ছাড়া নিরাপদ আশ্রয় সন্ধান করে রাখা, যাতে প্রয়োজনমতো সেখানে আশ্রয় নেওয়া যায়।
তবে শহরকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে, যা এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খননে পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা খালগুলোতে (স্থানীয় ভাষায় ছড়া) পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি। বিশেষ করে সিলেটের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা মালনিছড়া, যোগিনীছড়া, গোয়ালীছড়া, কালীবাড়িছড়া, মঙ্গলীছড়া, হলদিছড়া, ভুবিছড়া, ধোপাছড়া ও গাভীয়ার ছাড়াগুলোর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত হলে শহরের মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে কিছুটা রক্ষা পাবে। এ ছাড়া বন্যার কারণ ও প্রতিকারের স্থায়ী উপায় নিরূপণ করতে হবে। পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ কার্যকরের ব্যবস্থা নিতে হবে। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি করা যাবে, বন্যার আশঙ্কা তত কমে আসবে। আশার কথা, পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে প্রস্তুতি নিতে বলেছে প্রশাসন।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা