বেসরকারি চাকরিজীবীদের করছাড়ে বৈষম্যের ফাঁদ: ন্যায়সংগত সংস্কার জরুরি

ছবি: সংগৃহীত

বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য অনুমোদিত খরচের নামে কর ব্যবস্থায় এক প্রহসনের নাটক দীর্ঘদিন ধরে চলমান। ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালায় বেসরকারি খাতের একজন কর্মচারী তাঁর বেতনভিত্তিক আয়ের বিপরীতে সীমিত পরিমাণে খরচ দাবি করতে পারতেন, বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বছরে ৩ লাখ টাকা (বা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ, যেটি কম), চিকিৎসা খাতে বছরে সর্বোচ্চ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা (বা মূল বেতনের ১০ শতাংশ, যেটি কম) এবং যাতায়াতে ৩০ হাজার টাকা, সব মিলিয়ে মোট ৪ চার ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত ব্যয়।

পরবর্তী সময়ে কর আইন ২০২৩–এ এই সীমা সামান্য পরিবর্তন করে বেতন আয়ের ৩ ভাগের ১ ভাগ বা সর্বোচ্চ ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। অথচ বাস্তবতা হলো, এই আইনে বাস্তব জীবনযাত্রার ব্যয়, মুদ্রাস্ফীতি কিংবা কোভিড–পরবর্তী স্বাস্থ্য ব্যয়ের বিবেচনা ছিল অনুপস্থিত।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের নতুন বাজেটেও সেই একই বৈষম্যমূলক কাঠামো বহাল রাখা হয়েছে। সর্বোচ্চ করছাড় বাড়িয়ে মাত্র ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৫ লাখ নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ যেকোনো একটি বা ৩ ভাগের ১ ভাগ, যেটি কম, সেটিই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

এই বিধান সরাসরি সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করছে। সরকারি কর্মচারীরা সরকারি বাসভবন, যানবাহন, চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা সুবিধা—বেশ কিছু করমুক্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। অথচ বেসরকারি চাকরিজীবীরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েও করের বোঝা বহন করে চলেছেন।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে একজন সাধারণ বেসরকারি চাকরিজীবীর জন্য মাসিক বাড়িভাড়া, সন্তানের পড়ালেখা, অভিভাবকের চিকিৎসা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য, অফিস যাতায়াত ও চিকিৎসা ব্যয়—সব মিলিয়ে ব্যয়ভার বহন করা দিন দিন অসম্ভব হয়ে উঠছে।

নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

এনবিআরের বর্তমান চেয়ারম্যানকে আমরা একজন প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী পেশাজীবী হিসেবে জানি। কিন্তু সদ্য ঘোষিত বাজেটে বেসরকারি চাকরিজীবীদের জীবনযাত্রার বাস্তবতা বিবেচনায় না এনে করছাড়ের সীমা বাড়ানোর আড়ালে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত করের বোঝা, যা মধ্যবিত্তের জন্য শুধু আর্থিক চাপই নয়, মনস্তাত্ত্বিক হতাশাও বয়ে এনেছে।

একই সঙ্গে কর ফাঁকি ও অপ্রকাশিত আয়ের উৎস বন্ধে কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো রোডম্যাপের অনুপস্থিতি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ ও অসাম্যবোধ আরও বাড়িয়ে তোলে। এখন সময় এসেছে, এই বৈষম্যমূলক কাঠামো ভেঙে, বাস্তবমুখী ও মানবিক করনীতি প্রণয়ন করার।

প্রস্তাবিত ন্যায্য করছাড় কাঠামো হতে পারে—

•        বাড়িভাড়া খাতে: বছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা

•        চিকিৎসা খাতে: বছরে ৩ লাখ টাকা

•        যাতায়াত খাতে: বছরে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা

•        সন্তানদের পড়াশোনা ও পিতামাতার ভরণপোষণে: বছরে ২ লাখ টাকা

•        সর্বসাকল্যে: বছরে ১১ লাখ টাকা অথবা মোট আয়ের ৩ ভাগের ২ ভাগ (যেটি কম), করমুক্ত খরচ হিসেবে অনুমোদনযোগ্য

এমন একটি কাঠামো বাস্তবায়িত হলে এতে শুধু করের ভারই হালকা হবে না, বরং দীর্ঘ মেয়াদে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বেসরকারি খাতের কর্মীরাই দেশের প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি। তাঁদের শ্রম, দক্ষতা ও সততার বিনিময়ে জাতীয় রাজস্ব আয় বাড়ছে। অথচ তাঁদের ন্যায্য স্বীকৃতি না দিয়ে, অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই ‘নতুন বাংলাদেশ ২.০’-এর আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

এই যুক্তিসম্মত সংস্কার এখনই না আনলে, অচিরেই বেসরকারি খাতের কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হবে, যা আমাদের কারও কাম্য নয়। সুপরিকল্পিত, ন্যায়সংগত ও বাস্তবভিত্তিক করনীতিই হতে পারে একটি টেকসই, সমতাভিত্তিক নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি।

*লেখক: ফয়সাল ইসলাম, এফসিএ, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, দ্য ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফাইন্যান্স অ্যাকাউন্ট্যান্টস-ইংল্যান্ডের অ্যাসোসিয়েট সদস্য