কর্মসংস্থান সৃষ্টিই তারুণ্য-আন্দোলনের মূল চেতনা

ফাইল ছবি

‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনÑ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,/ ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,/ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ এ কথা বলার কারণ হচ্ছে, তারুণ্য বিরাট শক্তির আধার। উল্লিখিত কবিতার শেষে তা–ই বলা হয়েছে: ‘চিরযুবা তুই যে চিরজীবী,/ জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে/ প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।’

বাংলাদেশের বর্তমানের প্রেক্ষাপটে বললে, তারুণ্যশক্তির জয় হয়েছে। বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য তাদের নেতৃত্বের জয় হয়েছেÑস্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল বৈষম্যমুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তারা আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে অফুরন্ত রাস্তা। এ আলো কাজে লাগিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই হতে পারে তারুণ্যের আনন্দের একমাত্র কারণ। এখন তাদের তৈরি করা পথে আলো ছড়াতে হবে আমাদের।

বাংলাদেশ বেকারত্বে এগিয়ে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পিছিয়ে রয়েছে। শিল্পকারখানার নির্মাণ ও স্থায়িত্ব দিতে আমরা খুব একটা সফল হয়নি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব ও মারপ্যাচ প্রধান কারণ। কিছু পরিসংখ্যান এ ক্ষেত্রে বাস্তবতা অনুধাবনে সহয়তা করবে। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের’ (ইআইইউ) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা চাকরিপ্রার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা তাদের চাহিদামতো কাজ পাচ্ছেন না। বাংলাদেশের শতকরা ৪৭ ভাগ স্নাতকই বেকার। যেখানে ভারতে ৩৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮, নেপালে ২০ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বেকার রয়েছেন।

আইএলওর তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম। বেকারের সংখ্যা দেড়-দশকের তুলনায় বর্তমানে অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের শ্রমশক্তি ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রতিবছর ২ দশমিক ১ মিলিয়ন কর্মসংস্থান দরকার। ফলে বিপুল পরিমাণ যুবশক্তি কর্মসংস্থানের বাইরে থাকছে। এ অবস্থা আরও মারাত্মক হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে (আগস্ট, ২০২২), বাংলাদেশে, যুব বেকারত্বের হার বর্তমানে ১০ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে,Ñযা জাতীয় বেকারত্বের ৪ দশমিক ২ শতাংশের দ্বিগুণেরও বেশি। বিপুল এ সংখ্যা দেশের জন্য সম্পদ¤পদ না হয়ে বোঝা হচ্ছে। এ ধরনের হতাশাজনক পরিসংখ্যান দেখায় যে শিক্ষিত তরুণরা শীর্ষস্থানীয় ও নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে যথেষ্ট মনোযোগ পায়নি। তরুণ বা যুবশক্তিকে যদি আমরা কাজ না দিতে পারি, তাহলে রাজস্ব যেমন ব্যয় হবে বা আদায় কমে যাবে এবং সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর বিশাল চাপ দেবে। এতে দেশের উন্নয়ন শ্লথ হয়ে যাবে।

দেশের বড় একটা অংশ হচ্ছে যুব বা তরুণসমাজ। এ সমাজের ওপর নির্ভর করে সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিরতা ও শান্তিময়তা। দেশে তরুণসমাজ ভালো নেই; তরুণের তারুণ্য কাজে লাগাতে হবে। তরুণসমাজের বিপথ থেকে রক্ষা করতে আমরাই ব্যর্থ হয়েছি। তরুণসমাজে স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না! উন্নয়নও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারলে বিপুলসংখ্যক বেকার সমাজের বোঝা হয়ে যাবে। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হবে। তার নমুনা দেখতে পাই। চীনের ক্ষেত্রেও তরুণসমাজের একটি অংশ বেকার-বয়স্ক হয়ে বোঝা হয়ে গেছে। তরুণসমাজের নিরানন্দ রুখতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতেই হবে। কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা সরকারের আছে। বর্তমান সরকার অনেক এগিয়েছে। আরও বাড়াতে হবে। হাতে নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে এ ক্ষেত্রে অনেক সমাধান হবে। বেসরকারি খাতকে অনেক বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ায় অদক্ষ লোকের দাম নেই। অনেক ক্ষেত্রে জনবল ছাঁটাই করতে বিভিন্ন সংস্থা। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে তরুণসমাজকে সম্পদে পরিণত করতে অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। বাংলাদেশে যুববেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে মূলত চাহিদা ও জোগানের সীমাবদ্ধতার কারণে। চাহিদার বিপরীতে বৃহৎ যুব-জনগোষ্ঠীর জন্য বিনিয়োগ তেমন বৃদ্ধি পায়নি। ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে, ব্যক্তিগত বিনিয়োগ জিডিপির ২২ শতাংশ থেকে বেড়ে মাত্র ২৫ শতাংশ হয়েছে। সমস্যাটা এখানেই। শিক্ষিত তরুণরাই একটি জাতির সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। তবে বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের একটি বড় দল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে বঞ্চিত। ফলে, কর্মসংস্থান-সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তরুণদের প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা গ্রহণ অপর্যাপ্ত ও সময়োপযোগী নয় বা উপযোগিতা কম। এ বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার, বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ–বাস্তবায়ন করতে হবে। তরুণদের প্রাসঙ্গিক দক্ষতায় সজ্জিত করতে হবে। তাহলে পরিপূরক আয় সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে, যেখানে এ ধরনের দক্ষতা কাজে লাগানো যেতে পারে।

বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্য হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করে উন্নত দেশে রূপান্তরিত করা। সে ক্ষেত্রে মানুষের জীবনমান আরও উন্নত করা, মাথাপিছু আয় বাড়ানো, তরুণ প্রজন্মকে দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মে নিয়োগ দান করা। শিক্ষিত তরুণেরা যেন দেশ–বিদেশে চাকরি করতে পারেন, শ্রমবাজারে ছড়িয়ে পড়তে পারেন, সেই ব্যবস্থাও সরকারকে করতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই হতে পারে তরুণসমাজের সবচেয়ে বড় সমাধান। কর্মসংস্থানই তরুণদের পথচলাকে আনন্দময় করতে পারে। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের বড় তিনটি খাত পোশাক, চামড়া এবং ওষুধশিল্প। কিন্তু এ খাতের মূল পদগুলো বিদেশিদের দখলে। আর তার কারণ, আমাদের দক্ষ জনশক্তি নেই। আমরা পোশাকশিল্পের কথা জানি। সেটা কিন্তু পড়তির দিকেই। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প কর্মসংস্থানের বড় একটি খাত। আরও কয়েকটি খাত কর্মসংস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিজাত, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ, পর্যটন ও হালকা কারিগরি নির্মাণশিল্প ইত্যাদি এ পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু তারা চাহিদামতো দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছে না। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে এখন দরকার ডিজাইনার, বিশেষ করে ফ্যাশন ডিজাইনার। এমবিএ ডিগ্রিধারী হচ্ছে, কিন্তু বেশির ভাগই বেকার থাকছে বা চাহিদামতো চাকরি পাচ্ছে না। অন্যদিকে ফ্যাশন ডিজাইনার আনছি বিদেশ থেকে। পোশাক খাতেই আমরা বছরে বিদেশিদের বেতন দিয়ে থাকি অন্তত পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ অবস্থা অনেক সেক্টরে বিরাজ করছে। শিক্ষার পরিমাণগত হার বাড়ছে কিন্তু চাহিদাকৃত বা কোয়ালিটি শিক্ষার হার খুব কমই বাড়ছে। এ থেকে উত্তরণে উন্নত শিক্ষানীতি ও বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। মানসম্মত কারিগরি শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও উন্নতির স্থায়িত্ব রাখার পূর্বশর্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিভিন্ন আর্থসামাজিক সূচকে অনেক অগ্রগতি করেছে। তার পরও যুব বেকারত্ব-সমস্যা অনেক বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যুববেকারত্ব দেশের অন্যতম প্রধান নীতিগত চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। প্রতিবছর দুই মিলিয়নেরও বেশি লোক কর্মশক্তিতে প্রবেশ করে ধরে নিয়ে বৃহৎ শিক্ষিত যুবকদের চাকরির বাজারে স্থান দিতে। বাংলাদেশের তরুণরা যে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাগ্রহণ করে তা পর্যাপ্ত নয় বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। তরুণদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ জন্য তাদেরকে আধুনিক দক্ষতায় সজ্জিত করতে হবে। সরকারকে যথাযথ অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ মডিউল, দক্ষ প্রশিক্ষক এবং অন্যান্য মূল ইনপুট ইত্যাদির সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ বরাদ্দ ও নজর বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত বা জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চিহ্নিত-সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী নীতি গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য জাতীয় বা বাজেটে যুব-সংক্রান্ত বাজেট-বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, মনিটরিং জোরদার করতে হবে। বিনিয়োগের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এসব কার্যকর হলে যুবশক্তিকে ক্ষমতায়িত করা যাবে। তখন দিশাহারা তারুণ্য হবে আনন্দময়, দেশ পাবে অফুরন্ত শক্তির আধার। উন্নয়নের সিঁড়ি গড়তে গড়তে উন্নয়নের হিমালয় গড়া যাবে। তারণ্যশক্তি থাকবে সঠিক পথেইÑনিশ্চিন্তে, আনন্দে।

স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পতনে তারুণ্যশক্তির প্রবল সম্ভাবনাকে আমাদেরকে দেখিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। ঝলমলে তারুণ্যের দুরন্ত হাওয়ায় উড়তে থাকা সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে আমাদের। এরাই সৃষ্টি করবে নতুন কেতনের। এই তারুণ্যশক্তিকে কাজ দিয়ে আমাদেরকে কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে। এ-জন্য সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিখাতের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে আন্তরিকতার সঙ্গেই। ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে তরুণশক্তিকে কাজে লাগাতে পারব। তাদের পথচলাও হবে মসৃণ। তখন কাজী নজরুলের কণ্ঠে সুর মিলিয়ে তরুণদের উদ্দেশ্যে গাইব :

‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!’

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক