ডলারের আধিপত্য: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

মার্কিন ডলারফাইল ছবি: রয়টার্স

বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে ডলার কখনোই শুধুই একটি মুদ্রা ছিল না, এটি ছিল এক বিশাল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক। আজকের যুগে ডলার শুধু আমদানি-রপ্তানির লেনদেনে নয়, বরং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা, শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি, এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক প্রভাব। তবে, এই আধিপত্যের ভবিষ্যৎ কতটা টেকসই, এবং কীভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি এর ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারে, এসব বিষয় এখন বিশ্ববাজারের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়।

ডলারের আধিপত্যের পেছনে মূলত তিনটি কারণ কাজ করে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তি এবং আকার। বিশ্ববাজারে মার্কিন অর্থনীতি অন্যতম বৃহৎ, এবং এর স্থিতিশীল ও উন্নত পুঁজিবাজারে ডলারের মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারের গভীরতা এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ডলারকে বিশ্বের সর্বোচ্চ লিকুইড মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। বিশ্বের অন্য কোনো মুদ্রা এই স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। অন্যদিকে, মার্কিন অর্থনীতির বৃহৎ আকার এবং বৈচিত্র্য বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে ডলার ব্যবহারে একপ্রকার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

দ্বিতীয়ত, ডলারকে আন্তর্জাতিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে গ্রহণের বিষয়টি। বেশির ভাগ দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে ডলার ধরে রাখে। এর ফলে, বৈদেশিক লেনদেন, মুদ্রার অবমূল্যায়ন বা অস্থিরতা মোকাবিলায় ডলার ব্যবহৃত হয়। এই রিজার্ভ সুবিধা বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিকে কিছুটা নিরাপদ করে তোলে, এবং স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করে।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ডলারের ব্যবহার। বিশেষ করে তেল বা অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের দামে ডলার নির্ধারিত হয়, যা বিশ্ববাজারে ডলার প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করে। পেট্রোডলারের যুগে তেল বিক্রেতারা ডলারে দাম নির্ধারণ করে, আর এই প্রক্রিয়া ডলারের অপরিহার্যতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে, তেল কেনাকাটায় ডলার ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য আন্তর্জাতিক লেনদেনেও ডলারের ব্যবহার ক্রমশ বিস্তৃত হয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। বিশ্বের অনেক দেশ ও বিনিয়োগকারী মার্কিন ট্রেজারি বন্ডকে নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য পছন্দ করে থাকেন। এই বন্ডের ওপর আস্থা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এক নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কাজ করে, যা ডলারের শক্তিকে আরও বৃদ্ধি করে। ফলে, অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও বিশ্ববাজারে ডলারের আধিপত্য এখনো অটুট রয়েছে।

তবে, বর্তমান সময়ে ডলারের আধিপত্য কিছুটা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ইউরো, চীনের রেনমিন্বি, এবং ডিজিটাল মুদ্রার বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ক্রিপ্টোকারেন্সির আগমনে এই আধিপত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। ইউরো শক্তিশালী মুদ্রা হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক সংকট এই মুদ্রার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাকে সীমিত করে রেখেছে। অন্যদিকে, চীনের রেনমিন্বি এখনও সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি এবং এটি বিশ্ব বাজারে খুব একটা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে, ডলার এখনো বিশ্বব্যাপী প্রাধান্য বিস্তার অব্যাহত রেখেছে।

ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিটকয়েন, ইথেরিয়াম ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা (CBDC) ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে দেখা হলেও, এই মুদ্রাগুলোর মূল্য অস্থিতিশীলতা এবং আইনগত বাধা তাদের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। অনেক দেশ এখনো এই বিষয়ে স্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করেনি। ফলে, আন্তর্জাতিক লেনদেনে এই ডিজিটাল মুদ্রাগুলোর ব্যবহার সীমিত রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক দশকে ডলারের আধিপত্য ধীরে ধীরে কমতে পারে। এর পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে।

প্রথমত, বিশ্ব অর্থনীতি এখন বহু মুদ্রাব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে, যেমন ইউরো, রেনমিন্বি, এবং অন্যান্য মুদ্রার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই মুদ্রাগুলোর ব্যাপক ব্যবহার ডলারকে কিছুটা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধ্য করবে।

দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, যেখানে ক্রিপ্টোকারেন্সি ও CBDC ভবিষ্যতে ডলারের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে।

তৃতীয়ত, উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বাড়ানোর জন্য তাদের নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনের দিকে এগোচ্ছে। ব্রাজিল, চীন, ভারতসহ বেশ কিছু দেশ ডলার নির্ভরতা কমানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও কিছু উদ্যোগ নিতে পারে। যেমন নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন বাড়ানো, বিকল্প রিজার্ভ মুদ্রার ব্যবহার, এবং ডিজিটাল মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই নির্ভরতা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। পাশাপাশি, বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং অর্থনৈতিক সংস্কার আনা দেশের জন্য অপরিহার্য।

তবে, এই পরিবর্তনগুলো ডলারের সম্পূর্ণ বিলোপ বা প্রাধান্য হারানোর জন্য যথেষ্ট নয়। ডলার ইতিমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে এতটাই গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে যে এর স্থান দখল করতে গেলে অনেক বড় পরিবর্তন ও সময় লাগবে। ডলারের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে এর বিকল্প তৈরি এখনো সম্ভব হয়নি। এর পাশাপাশি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তি, বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতি, এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখনো ডলারকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে রেখেছে।

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বল মুদ্রার অস্থিরতা, বৈদেশিক ঋণ, রেমিট্যান্স ও আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ডলারের প্রভাব অনেক সময় দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। এই জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বৈচিত্র্যময় রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক গঠন শক্তিশালী করার। এর মাধ্যমে, ডলারনির্ভরতা কমিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও কিছু উদ্যোগ নিতে পারে। যেমন নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন বাড়ানো, বিকল্প রিজার্ভ মুদ্রার ব্যবহার, এবং ডিজিটাল মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই নির্ভরতা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। পাশাপাশি, বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং অর্থনৈতিক সংস্কার আনা দেশের জন্য অপরিহার্য।

অতএব, বলাই যায় যে ডলার আজকের বিশ্ব অর্থনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর আধিপত্য কিছুদিনের জন্য বা সাময়িকভাবে কমলেও, এটি সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। পরিবর্তন আসবে, তবে ধীরে ধীরে। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে বহু মুদ্রাব্যস্থার বিকল্প বা ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসার ঘটলেও, ডলার এখনো এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এখনই সময়, সঠিক পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণের, যাতে তারা এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বৈচিত্র্যকরণ, এবং প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, এই তিনটি মূল ভিত্তির ওপর ভিত্তি করে আমরা ভবিষ্যতের বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজের জায়গা নিশ্চিত করতে পারি। ডলারের আধিপত্য হ্রাসের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে এখনই, কারণ সময়ের স্রোত কখনো থামে না। সঠিক পরিকল্পনা, দৃঢ় অঙ্গীকার এবং একাগ্রতায় আমরা এগিয়ে যাব সেই দিকে, যেখানে আমাদের অর্থনীতির স্বাধীনতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে।

লেখক: মাহমুদুল হাসান এফসিসিএ, চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা।