ইন্টারন্যাশনাল ডে অব লিসেনিং: অন্যকে শুনি...

ফাইল ছবি প্রথম আলো

কখনো ভেবে দেখেছেন, শোনার জন্য আমাদের দুটি কান থাকলেও বলার জন্য মুখ কেন একটি! মনের কথাটাও আমাদের মুখ দিয়েই বলতে হয়, তবে অন্যকে শোনার জন্য কান দুটি ছাড়া আমাদের একটি মনও আছে। অর্থাৎ মন বলতে না পারলেও শুনতে ঠিকই পায়। এ থেকে কিছুটা হলেও বোঝা যাচ্ছে, অন্যকে শোনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ; অন্তত নিজে বলার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিক দার্শনিক এপিকটেটাস তো বলেই ফেলেছেন, ‘আমাদের দুটি কান ও একটি মুখ আছে, যাতে আমরা যতটা বলি তার দ্বিগুণ যেন শুনতে পারি।’

অন্যকে শোনার বিশ্ব আয়োজন...

নিজে বলার চেয়ে অন্যের কথা শোনার গুরুত্বের তাৎপর্য উপলব্ধি করার লক্ষ্যে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাপী ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব লিসেনিং’ উদ্‌যাপন করা হয়। সে হিসাবে এ বছর দিবসটি উদ্‌যাপিত হচ্ছে ১৫ সেপ্টেম্বর। এই দিনকে অন্যকে শোনার সৌন্দর্যচর্চার দিন হিসেবেও গণ্য করা হয়। ‘দ্য ফাদার অব লিসেনিং’খ্যাত ড. র‌্যালফ জি নিকোলস ১৯৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার প্রভাষক থাকাকালে ইন্টারন্যাশনাল লিসেনিং অ্যাসোসিয়েশন (আইএলএ) প্রতিষ্ঠা করেন। আইএলএ লিসেনিং বিষয়ে অধ্যয়ন, উন্নয়ন ও শিক্ষকতাকে উৎসাহিত করে থাকে। এ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার লক্ষ্য নিয়ে সংস্থাটি ২০১৬ সাল থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব লিসেনিং’ উদ্‌যাপন শুরু করে।

কেন শুনতে হবে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩০তম প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বলেছিলেন, ‘ইট টেকস আ গ্রেট ম্যান টু বি আ গুড লিসেনার’, বাংলায় বললে ‘মহান কিংবা সফল মানুষমাত্রই ভালো শ্রোতা’। অর্থাৎ জীবনে সফল হওয়ার অন্যতম একটি শর্ত হলো ভালো শ্রোতা হওয়া।

এ বছর দিবসটি উদ্‌যাপনের জন্য প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘লিসেন টু হিল’, যার বাংলা ‘নিরাময়ের জন্য শুনুন’। অর্থাৎ ভালো থাকতে হলে শুনুন। ভয়াবহ এক মহামারি কাটিয়ে ওঠা জীবনের ক্ষতগুলো সারিয়ে আবারও সব ফিরে পাওয়ার তাড়না অনুভব করছে বিশ্ব। অতি সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের বুক আঁচড়ে তছনছ করে দেওয়া এই মহামারি তার কালো ছাপ রেখে গেছে আমাদের শারীরিক, মানসিক, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, এমনকি কর্মজীবনেও। এ থেকে উত্তরণের জন্য, আলো ফিরে পাওয়ার জন্য আমাদের এখন শুনতে হবে একে অন্যকে।

কিন্তু কীভাবে শুনবেন

সবাই আসলে ভালো শ্রোতা হতে পারেন না। দুঃখজনক হলেও ব্যাপারটি সত্যি। স্বভাবজাত কারণেই মানুষ শোনার চেয়ে বলতে চায় বেশি। যার কারণে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অধিকাংশ সমস্যারই সমাধান বের করা কঠিন হয়ে যায়। কখনো কখনো অমীমাংসিতই থেকে যায়। আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনেও এই ‘না শোনার দায়’ আছে অনেকখানি। আমরা প্রায়ই আত্মহত্যার খবরগুলোয় দেখতে পাই, নিঃসঙ্গতা আর নিজের কথা না বলতে পারাই আত্মহত্যাকারীদের ধীরে ধীরে খুন করেছে। ভালো শ্রোতা হতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দক্ষতা। একজন ভালো শ্রোতাই অন্যের সমস্যা মনোযোগসহ শুনতে পারেন। যিনি যত ভালো শোনেন, তিনি তত বেশি আস্থা অর্জন করতে পারেন।

ভালো শ্রোতা হবেন কীভাবে

কয়েকটি ছোট কৌশল অনুসরণ ও চর্চার মাধ্যমে নিজেকে ভালো শ্রোতা হিসেবে গড়ে নিতে পারেন। এই যেমন কথোপকথন শুরুর জন্য ভালো একটা পরিবেশ বেছে নিন অথবা পরিবেশটা নিজেই তৈরি করে নিন। এ ক্ষেত্রে নীরবতাই শ্রেয়। অর্থাৎ শ্রোতা ও পরিবেশ—দুটিই নীরব হলে উত্তম কথোপকথন আশা করা যায়। কথোপকথন সফল করতে উপযুক্ত প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ‘কথার মাঝে কথা’ পরিহার করতে হবে, বক্তাকে তাঁর কথা কোনো বাধা ছাড়াই বলতে দিন। ‘কোনটা সঠিক’, তা বলার জন্য অস্থির হবেন না। সময় নিন, শুনুন। সিদ্ধান্তে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করবেন না।
ভালো শ্রোতা হয়ে ওঠার জন্য রকেটবিজ্ঞান জানা লাগবে না। অন্য সব বিষয়ের মতো এটাও বেশি বেশি চর্চায় আয়ত্ত করা যায়। ভালো শ্রোতা হওয়ার সুফলের পরিসর আসলে অনেক বড়। শুনলে আস্থা বাড়ে, ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হয় এবং দ্বন্দ্ব নিরসন হয়। শুধু তা-ই নয়, সম্পর্কে মিষ্টতার সঙ্গে বাড়ে গভীরতাও। আমরা তো অনেকেই চাই, কারও আস্থা কিংবা অবলম্বন হব। চাইব নাই-বা কেন! জীবনে চলার পথে কারও ভরসা হয়ে উঠতে পারা নিশ্চয়ই তৃপ্তির। চলুন, শুনি। ভালো থাকার জন্য শুনি।

লেখক: আকলিমা জান্নাত, কনটেন্ট ডেভেলপার, সাবেক শিক্ষার্থী, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়