বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যে যে উদ্যোগ প্রয়োজন
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এক ঐতিহাসিক ঘোষণা এসেছে বেসরকারি ও করপোরেট খাত থেকে—‘আমাদের হাসপাতালে বিছানা খালি থাকা সাপেক্ষে অর্থের অভাবে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাবে না কোনো রোগী।’ ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মঈনুদ্দিন হাসান রশীদের এই বক্তব্য নিছক কোনো প্রচারণামূলক উক্তি নয়, বরং দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যৎ রূপরেখায় এক যুগান্তকারী অঙ্গীকার।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অবদান অসামান্য। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার প্রায় ৭৩% দিয়ে থাকে বেসরকারি হাসপাতাল। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই, তা হলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে। সরকারি হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত রোগীর চাপে বিপর্যস্ত, আর বেসরকারি হাসপাতালগুলো আধুনিক হলেও অনেকের নাগালের বাইরে। এই বৈষম্য কমাতে সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগ—পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP)—হতে পারে এক নতুন যুগের সূচনা। ইতিমধ্যে ইউনাইটেড গ্রুপ পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং সরকারের সাথে কাজ করে স্বাস্থ্য খাতে নতুন আশার সঞ্চার করতে ইচ্ছুক। স্বাস্থ্যসেবা একটি মৌলিক অধিকার, কিন্তু একে কার্যকরভাবে নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকে দক্ষতা, প্রযুক্তি ও বিনিয়োগে বেসরকারি খাতের সহায়তা নিতে হবে। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলো জনবলসংকট, যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা ও রক্ষণাবেক্ষণের সীমাবদ্ধতায় ভুগছে। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলো মানসম্মত চিকিৎসা দিতে পারলেও সাধারণ মানুষের জন্য তা প্রায়ই ব্যয়বহুল।
এই অবস্থায় PPP হতে পারে দুই দিকের সেতুবন্ধ—যেখানে সরকার অবকাঠামো ও নীতিগত সহায়তা দেবে, আর বেসরকারি খাত দেবে বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা ও সেবা মান। ২০১০ সালে সরকার “PPP Policy and Strategy” প্রণয়ন করে। এরপর অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে অনেক সফল প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন স্বাস্থ্য খাতেও PPP মডেল চালুর পরিকল্পনা করছে সরকার।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও PPP অথরিটির যৌথ উদ্যোগে কিছু প্রকল্পের নকশা তৈরি হয়েছে, যেমন জেলা হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সার্ভিস, ডায়ালাইসিস ইউনিট এবং মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন। এই ধারাকে এগিয়ে নিতে পারলেই স্বাস্থ্যসেবার পরিধি আরও বিস্তৃত হবে।
বাংলাদেশের বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে ইউনাইটেড গ্রুপ ইতিমধ্যে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ইউনাইটেড হাসপাতাল, ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ এবং ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসেস—এই প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক চিকিৎসা, গবেষণা ও শিক্ষা খাতে মানদণ্ড তৈরি করেছে। ইউনাইটেড গ্রুপের মূল শক্তি হলো তাদের পেশাদার ব্যবস্থাপনা, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সক্ষমতা এবং চিকিৎসা প্রযুক্তিতে দক্ষতা। তাই তারা PPP মডেলে সরকারের সঙ্গে অংশীদার হয়ে আঞ্চলিক বা বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিতে ইচ্ছুক। বিশেষ করে Build–Operate–Transfer (BOT) বা Management Contract ভিত্তিক মডেলে সরকারি অবকাঠামো ব্যবহার করে ইউনাইটেড গ্রুপ যদি সেবা চালায়, তবে চিকিৎসার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি সাধারণ মানুষও পাবেন সাশ্রয়ী সেবা। PPP প্রকল্প সফল করতে হলে দরকার কিছু মৌলিক বিষয়, যেমন চুক্তির স্বচ্ছতা ও রাজস্ব ভাগাভাগির স্পষ্টতা, মান নিয়ন্ত্রণের স্বাধীন কাঠামো এবং জনস্বার্থে মূল্য নির্ধারণের ন্যায্যতা। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা ও চিকিৎসা–বিমা কাঠামোর উন্নয়নও জরুরি।
সরকার চাইলে জেলা পর্যায়ে একটি “PPP মেডিকেল কমপ্লেক্স” পাইলট প্রকল্প হিসেবে শুরু করতে পারে, যেখানে সরকারি জমি ও অবকাঠামো ব্যবহার করে ইউনাইটেড গ্রুপের মতো অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান সেবা পরিচালনা করবে। এতে সাশ্রয়ী, দক্ষ ও মানসম্মত চিকিৎসা একই সঙ্গে নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা আজ এক মোড়ে দাঁড়িয়ে। সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, আবার বেসরকারি উদ্যোগ একা টেকসইও নয়। তাই পারস্পরিক সহযোগিতাই হতে পারে টেকসই সমাধান। যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা যায়, তবে পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব আধুনিক ও মানবিক স্বাস্থ্যসেবা। এই যাত্রায় নেতৃত্ব নিতে পারে দেশের অন্যতম সফল প্রতিষ্ঠান—ইউনাইটেড গ্রুপ। স্বাস্থ্যসেবায় এটি হতে পারে এক দারুণ সফল উদ্যোগ।
উন্নত প্রযুক্তি, দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক এবং মানসম্মত সেবার কারণে সাধারণ মানুষ ক্রমেই বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর ভরসা করছে। তবে বাস্তবতা হলো ব্যয়বহুল চিকিৎসা ও বিভিন্ন আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই এই সেবা নিতে পারছেন না। বিশেষ করে প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বহু রোগী বাধ্য হয়ে বেসরকারি/করপোরেট হাসপাতালের দরজা থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
এই প্রেক্ষাপটে ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যানের ঘোষণা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে এক নতুন আশার আলো। এটি কেবল ইউনাইটেড হেলথকেয়ার ও ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজের জন্য নয়, বরং গোটা করপোরেট এবং অন্যান্য বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য একটি সামাজিক দায়বদ্ধতার এক অনন্য মডেল।
বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতকে অনেকে কেবলই ব্যবসা হিসেবে দেখেন। এ ধারণা পুরোপুরি সত্য না হলেও আংশিক সত্য। কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদানের মাধ্যমে এই ধারণাকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করার এখনই সময়। আর আমরা এ–ও জানি চিকিৎসা পেশার মূল ভিত্তি হলো মানবিকতা। করপোরেট এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে মানবিকতার চর্চা করতেও উৎসাহ প্রধান করতে পারে। এই ক্ষেত্রে ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যানের ঘোষণাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এ ব্যাপারটিকেও আমলে নিতে হবে যে অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন, একই সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিষ্ঠাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
‘কোনো রোগী যাবে না ফিরে’—এই প্রতিশ্রুতি আসলে মুনাফাভিত্তিক ধারণাকে ভেঙে দিয়ে একটি মানবিক ও নৈতিক অবস্থান তৈরি করতে ভূমিকা রাখবে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে করপোরেট এবং বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয় নিয়ে শঙ্কিত। তাঁরা বিশ্বাস করেন এবং এটাই প্রকৃত সত্য, টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা তাঁদের নাগালের বাইরে। এই ঘোষণার মাধ্যমে সেই আস্থাহীনতার দেয়াল ভাঙার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যদি মানুষ অনুভব করে যে বেসরকারি হাসপাতাল যেকোনো বিপদে তাঁদের পাশে থাকবে, তবে এটি সমাজে গভীর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। হাসপাতাল বা চিকিৎসক সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক প্রভাব কাটাতেও ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যানের এই অঙ্গীকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য খাতে ইউনাইটেড গ্রুপের অবদান অনস্বীকার্য। ইতিমধ্যে গ্রুপটি ইউনাইটেড হাসপাতালকে একটি সফল করপোরেট হিসেবে গড়ে তুলেছেন, যা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা বিশেষ করে কার্ডিয়াক সেবায় নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। এ ছাড়া জামালপুরে কয়েকটি বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং ইউনাইটেড ট্রাস্টের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য একটু চক্ষু হাসপাতাল নিরলসভাবে ফ্রি বা নামমাত্র মূল্যে লেন্স প্রতিস্থাপনসহ সব ধরনের চিকিৎসা নিশ্চিত করে প্রান্তিক জনমানুষের সেবায় দিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা খাতেও ইউনাইটেড গ্রুপ অভূতপূর্ব অবদান রেখে যাচ্ছে।
এই অঙ্গীকারের সম্ভাব্য প্রভাবসমূহের মধ্যে সামাজিক প্রভাব, নীতিগত প্রভাব, রাষ্ট্রীয় প্রভাবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত রোগীরাও উন্নত চিকিৎসার আওতায় আসতে পারবেন। এমনকি বেসরকারি খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের উদ্যোগ নিতে উৎসাহিত হবে। এতে আরেকটি লাভও হবে, তা হলো সরকারি হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে, ফলে বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরও ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে এ ধরনের ইতিবাচক উদ্যোগ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে একটি মানবিক মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে সাহায্য করবে।
অবশ্যই এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন তখনই সহজ হবে, যখন আর্থিক সীমাবদ্ধতাসম্পন্ন রোগীদের শনাক্তকরণে, স্বাস্থ্যবিমা কাঠামোর অভাব কাটিয়ে ওঠা, চিকিৎসা ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং আর্থিকভাবে অসচ্ছল রোগীদের প্রয়োজনীয় ভর্তুকি নিশ্চিত করা। উপরিউক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত হলেই রোগীর চিকিৎসা না পাওয়ার মতো বিষয় সমাধান হবে।
তবে ইউনাইটেড গ্রুপ স্বাস্থ্য খাতে আগেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এখন সঠিক নীতি, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে ইউনাইটেড ট্রাস্টের মাধ্যমে শক্তিশালী ‘পেশেন্ট সাপোর্ট ফান্ড’ গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছে। এই ফান্ড গঠনের মাধ্যমে উপরিউক্ত ঘোষণা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
একবিংশ শতাব্দীতে স্বাস্থ্যসেবা কেবল বিলাসিতা নয়; এটি প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের বেসরকারি খাত দীর্ঘদিন ধরে মানসম্মত সেবায় অগ্রণী হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবিক প্রতিশ্রুতির ঘাটতি ছিল। ইউনাইটেড গ্রুপ চেয়ারম্যানের এই ঘোষণা সেই ঘাটতি পূরণের এক সাহসী উদ্যোগ।
আমরা আশা করি, এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে এবং অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণে অনুপ্রাণিত হবে। তাহলে একদিন হয়তো বাংলাদেশে সত্যিই এমন এক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যেখানে কোনো মানুষ অর্থাভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবেন না।
*লেখক: আশরাফ জুয়েল, চিকিৎসক, ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিস লিমিটেড